পিছন থেকে জন সান্ত্বনার গলায় বলে, “তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয় রতন, কিন্তু বোকামির নয়।”
জন রিভলভারটা নামিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখে। তারপর বলে “বাঃ, রঙ্গমঞ্চ তো দেখছি আমাদের দখলে।”
রতন হুঁশ ফিরে পেয়ে বলে, “না, এখনো নয়। ডগলাসের লোকেরা তোমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। যে-কোনো মুহূর্তে এসে পড়বে।”
“জানি।” জন শান্ত স্বরে বলে, “কিন্তু তারা ডগলাসের ল্যাবরেটরিতে ঢুকবার সাহস পাবে না। রোলো, ভিতরে এসে দরজাটা ভাল করে সেঁটে দাও।”
রতন উদ্বেগের গলায় বলে, “কিন্তু আমরা বেরোব কী করে?”
“রাস্তা আছে।” বলে জন ল্যাবরেটরির একটা টেবিল সরায়। নিচে পাটাতনে একটা ম্যানহোলের ঢাকনার মতো বস্তু। জন সেটা তোলে। বলে, “এসো।”
ঘোরানো একটা লোহার সিঁড়ি বেয়ে তারা নামে। খুব নিচে নয়। মাত্র একতলা নেমে জন অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রতনের হঠাৎ খেয়াল হয়, রোলো এখনো নামেনি।
একটু বাদেই অবশ্য রোলো নেমে আসে নিঃশব্দে।
রতন জিজ্ঞেস করে, “রোলো এতক্ষণ কী করছিল জন?”
জন মৃদু ব্যথিত স্বরে বলে, “কেন শুনতে চাও?”
“কেন শুনব না? কী করছিল রোলো?”
জন মৃদু স্বরেই বলে, “যা করছিল তা ভদ্রলোকের কাজ নয়। বিপ্লবীদের অনেক সময় এরকম অপ্রীতিকর কাজ করতে হয়।
শত্রুর শেষ রাখতে নেই। সেই কাজটুকু ও শেষ করে এল।”
“তার মানে কি মেরে ফেলল সবাইকে?”
“বলেছিলাম তো, শুনতে চেও না। ডগলাস বেঁচে থাকলে আমাদের কোথাও পরিত্রাণ ছিল না। একজন পুতুলের মতো ছোট্ট মানুষ যে কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে, তা যারা ডগলাসকে জানে না, তারা কল্পনাও করতে পারবে না।”
অনেকখানি নিচে নামল তারা। তারপর এক জায়গায়
দেয়ালের গায়ে একটা হুইল ঘোরায় জন। ছোট্ট একটা ফোকর দেখা যায় দেয়ালে। জন উঁকি মেরে দেখে নিয়ে বলে, “জাহাজে লোড থাকলে এই ফোকর থেকে জলের লেভেল মাত্র ছ’ফুট। লোড না থাকলে বিশ ফুট বা তারও বেশি। লোড আছে, সুতরাং বিপদের ভয় নেই। তোমার বাবাকে একটু সাবধানে নামিও রতন। আমাদের স্পীডবোট মাত্র দশ ফুট দূরে রয়েছে। সামান্য একটু সাঁতরাতে হবে। পারবে না?”
“পারব।” রতন বলে। বাইরে কুয়াশা ছিল। চারজন নিঃশব্দে সকলের অলক্ষ্যে এসে বোটে উঠল। জাহাজ থেকে কেউ লক্ষ করছিল না হয়তো। কে জানে!
রোলো বোটে উঠে ছাদ থেকে জাহাজের দড়ির মইটা খুলে ছেড়ে দিল। তারপর কেবিনের পাটাতনের তলা থেকে দুটো স্পার্ক প্লাগ বের করে ইঞ্জিনে লাগিয়ে নিল। দড়ির মইটা খুলে দেওয়াতে বোটটা ঢেউয়ে দুলে সরে এসেছিল একটু। রোলো স্পীডবোটের মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে স্টার্ট দিল। তারপর নক্ষত্ৰবেগে ছুটে গেল উল্টো দিকে।
মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল রতন। বিমর্ষ গলায় বলল, “সর্বনাশ হয়েছে জন।”
“কী হয়েছে?”
“আমার মোজার মধ্যে সেই মাইক্রোফিল্মটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। খেয়াল ছিল না। জলে সেটা বোধহয় গেছে।”
জন বলল, “হায় ঈশ্বর!” রোলোও একটা অদ্ভুত শব্দ করল সামনে থেকে।
জন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কী আর করা যাবে! আমার ইচ্ছে ছিল তোমার বাবাকে অ্যামেরিকায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলব। তারপর ফিরে এসে তিনি হিট অ্যামপ্লিফায়ার নিয়ে কাজ করবেন। আমি হব তাঁর আন্তজাতিক এজেন্ট। তা আর হল না।”
বাঞ্ছারাম চোখ মেললেন। চারিদিকে চেয়ে হঠাৎ বললেন, “মাইক্রোফিল্মেরও দরকার নেই। আমার চিকিৎসারও দরকার নেই।”
বাঞ্ছারাম মৃদু হেসে বলেন, “আমি স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়েছি। হিট অ্যামপ্লিফিকেশনের ফরমুলা আজও ভুলিনি। কাজ কিছু কঠিন হবে না। নিজের ল্যাবরেটরিতে ফিরে গিয়েই কাজ শুরু করব।”
স্তম্ভিত জন বলে, “আপনি কি সুস্থ?”
“পুরোপুরি। হিট অ্যামপ্লিফায়ার নামটা এরকম অদ্ভুত কেন জানো? আমি তাপকে বাড়ানোর জন্য একটা শব্দের সাহায্য নিয়েছি। এই সাইলেন্ট সাউন্ড। মানুষ তা কানে শুনতে পায় না। মৃদু একটা কম্পন মাত্র। সবই আমার মনে আছে।”
আনন্দে জন বাঞ্ছারামকে জড়িয়ে ধরে বলে, “কিন্তু কী করে আপনি সুস্থ হলেন?”
বাঞ্ছারাম মৃদু হেসে বললেন, “বোধহয় শক থেরাপি। ওরা আমাকে প্রচণ্ড মারধর করেছিল, টুথ ইনজেকশন দিয়েছিল। সেই সব শক কখন আমার মাথার ধোঁয়া কাটিয়ে দিয়েছে।” এই বলে বাঞ্ছারাম রতনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমিই রতন?”
রতন উঠে এসে শ্লীপিং ব্যাগে ঢাকা বাঞ্ছারামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। কান্নায় অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ বাবা।”
বাঞ্ছারাম শ্লীপিং ব্যাগ থেকে হাত বের করে রতনের মাথায় রাখলেন। “তুমি যে এত বড় হয়েছ তা আমি বুঝতেই পারিনি। দীর্ঘদিন আমি এক অদ্ভুত মানসিক তন্ত্রায় আচ্ছন্ন ছিলাম। আমার
দিদি কি বেঁচে আছে?”
“আছে বাবা।”
জন আর রোলোকে দেখিয়ে বাঞ্ছারাম জিজ্ঞেস করেন, “এরা কারা? তোমার বন্ধু?”
জন হাত বাড়িয়ে বাঞ্ছারামের হাত চেপে ধরে বলে, “আমরা আপনাদের বন্ধু।”
বাঞ্ছারাম একটু হাসলেন।
তাঁরা বাড়িতে পৌঁছলেন দুপুর পার হয়ে। রতনের পিসি আনন্দে কাঁদতে লাগলেন। রঘু চেঁচাতে-চেঁচাতে লাফাতে লাগল। পাড়া-প্রতিবেশী ভিড় করে দেখতে এল বাঞ্ছারামকে। আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে রিপোর্টার, পুলিশের লোক, বাঞ্ছারামের পুরনো বন্ধু বান্ধবরা।
অনেক রাতে অভ্যাগতরা বিদায় হল। জন আর রোলো ফিরে গেল তাদের হোটেলে। পিসি আর রতন ঘুমিয়ে পড়ল। এখন বাঞ্ছারাম তাঁর সাধের ল্যাবরেটরিতে এসে ঢুকলেন। ভ্রু কুঁচকে চারদিকে চেয়ে দেখলেন একটু। সব আবার সাজিয়ে তুলতে সময় লাগবে কিন্তু তাতে কী? তিনি এখন প্রচণ্ড উদ্যম বোধ করছেন ভিতরে ভিতরে। শত্রুপক্ষ তাঁর অনেক উপকার করেছে।