জন তাকে বলেছিল, “বিপদে পড়লে কোনো দ্বিধা কোরো। সরাসরি আঘাত কোরো। এইসব দুর্জন মুখোমুখি কনফ্রনটেশনের কাছেই বরং কখনো-সখনো হারে।” কথাটা মনে পড়তেই মরিয়া রতন চট করে এক পা এগোল।
কিন্তু পুতুলের মতো ছোট্ট লোকটা জাদুই জানে বুঝি। চোখের পলকে তার হাতে দেখা দিল সেই মৃত্যহিম ছোট্ট রিভলভারটা। সে বলল, “রিভলভারের তাক খুবই অনিশ্চিত। বেশির ভাগ সময়েই তা লক্ষ্যবস্তুর অনেক দূর দিয়ে চলে যায়। তাছাড়া আমার এই ছোট্ট যন্ত্রটা কমজোরিও বটে। তবু তোমাকে বলি, কোনোরকম নির্বোধ কাজ কোরো না।”
সাদা পোশাক পরা ডাক্তার এতক্ষণ নীরবে অবাক চোখে দৃশ্যটা দেখছিল। হঠাৎ বাঞ্ছারাম মৃদু একটা শব্দ করতেই সে এগিয়ে গেল। রুগিকে পরীক্ষা করে সে ডগলাসের দিকে চেয়ে বলল, “টুথ ইনজেকশনের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এর চেতনা ফিরবে। কী করব ডগলাস, একে ঘুম পাড়িয়ে দেব?”
ডগলাস এক পলকের জন্যও রতনের দিক থেকে চোখ ফেরায়নি। সেইভাবে থেকেই বলল, “না। একে জাগতে দাও।” তারপর রতনকে বলল, “আমার মনে হয়, তুমি একা আসনি। সঙ্গে আর কে আছে?”
“কেউ না।”
ডগলাস সেকথা বিশ্বাস করল না। কোণের টেবিলে গিয়ে টেলিফোনটা তুলে নিল। একটুক্ষণ কথা বলেই আবার রতনের মুখোমুখি দশ ফুট দূরত্বে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে আরো দুজন এসেছে। তোমরা তিনজনে মিলে আমার তিনজন লোককে ঘায়েল করেছ। তোমার আর দুজন সঙ্গী কোথায়?”
রতন চুপ করে রইল।
ডগলাস বলল, “আমার লোক তাদের খুঁজছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ধরা পড়বে। সুতরাং তোমার কষ্ট করে না বললেও চলবে।”
রতন পরাজয়ের গ্লানি টের পাচ্ছিল। আসলে চালে একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। এখন আর কিছুই করার নেই।
সে তার বাবাকে পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছিল। হুইল চেয়ারে বসা, অসহায় বুড়ো একজন মানুষ। যার ভাল মন্দ কোনো বোধ নেই, স্মৃতিশক্তি নেই। তবু এই পাগল অসহায় লোকটাকেও এরা খুন করবেই। কিন্তু বাবার দিকে এক পাও এগোবার উপায় নেই। তাতে দুজনের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করা হবে মাত্র।
ডাক্তার ঝুঁকে বাঞ্ছারামের নাড়ি দেখছিল। বাঞ্ছারাম নানা ধরনের শব্দ করছিলেন–”ওঃ! উঃ! ওরে বাবা! রসগোল্লা খাব।”
বোঝা গেল বাঞ্ছারামের চেতনা ফিরে এসেছে। রতন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কেন যে তার বাবা হিট অ্যামপ্লিফায়ার আবিষ্কার করতে গিয়েছিলেন! সে শুনেছে, তার বাবাও যৌবনকালে একজন ভাল মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি যদি মুষ্টিযোদ্ধাই থেকে যেতেন, বৈজ্ঞানিক না হতেন, তবে পাগলও হতেন না, আজ এই বিপদও ঘটত না।
হঠাৎ ডগলাস বাঞ্ছারামের দিকে চেয়ে বলল, “এই ছেলেটিকে চিনতে পারো? দ্যাখো তো ভাল করে চেয়ে। এ কি তোমার ছেলে?”
বাঞ্ছারাম আস্তে মুখ ঘোরালেন। রতনের দিকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
কিন্তু রতন বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। ছেলেবেলা থেকেই সে বাবার চোখে যে ঘোলা-ঘোলা, অনিশ্চিত, উদাসীন চাউনি দেখে এসেছে, এই চাউনি মোটেই সেরকম নয়। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল, বাবার চোখ অন্যরকম। আগের চেয়ে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ, তাতে বুদ্ধির ঝিকিমিকি।
বাঞ্ছারাম চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, “না, না। এ আমার ছেলে নয়। আমি রসগোল্লা খাব।”
ডগলাস রিভলভারটা হোলস্টারে ভরে আবার বেল টিপল। দরজা খুলে সেই দুটো লোক ঘরে ঢুকতে ডগলাস বলল, “বুড়োকে কেবিনে নিয়ে যাও। আর এই ছোকাকে আটকে রাখো।”
লোকদুটো এগিয়ে আসছিল হুইল চেয়ারের দিকে। ডগলাস তীক্ষ্ণ চোখে নজর রাখছিল রতনের দিকে। ডাক্তার তার যন্ত্রপাতি গোছাচ্ছিল। ঠিক এইসময়ে অভাবনীয় একটা ঘটনা ঘটল।
আচমকা বৃদ্ধ অশক্ত পাগল বাঞ্ছারাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাত্র এক পা এগিয়ে একটু নিচু হয়ে তিনি ডান হাতে প্রচণ্ড একটা ঘুষি মারলেন ডগলাসকে। সে ঘুষির বহর দেখে রতনও অবাক হয়ে গেল। চেতনা হারানোর আগে ডগলাসও
বোধহয় বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। এমন কী, ডগলাসের দুই স্যাঙাত পর্যন্ত থমকে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
বড় ভুল করল তারা। কাছেপিঠে একজন সুদক্ষ মুষ্টিযোদ্ধা থাকলে এরকম চালে ভুল করতে নেই। যে দু তিন সেকেন্ড তারা পাথর হয়ে ছিল, সেই সময়ে রতন সক্রিয় হল। তার দুখানা ঘুষি দেড়মনি পাথরের মতো গিয়ে একজনের চোয়াল ভেঙে দিল।
সে কুমড়ো-গড়াগড়ি হয়ে পড়ে যেতেই অন্যজন ফিরে দাঁড়িয়েছিল রতনের দিকে। তখন পিছন থেকে বাঞ্ছারাম একটা কাঁচের জার বিদ্যুৎ-বেগে তুলে নিয়ে তার মাথায় মারলেন।
এ পর্যন্ত বেশ হল। কিন্তু বাপ-ব্যাটা হঠাৎ দেখল, ডাক্তার লোকটা ডগলাসের রিভলভার বাগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “হাত তোলো, পিছনের দিকে সরে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াও।”
দুজনেই হাত তোলে। কিন্তু রতনের ভিতরে ডগলাসের কথাটা টিকটিক করতে থাকে। রিভলভারের তাক নাকি অনিশ্চিত। প্রায়ই তা লক্ষ্যবস্তুর গায়ে লাগে না। কথাটা সত্যি কিনা তা রতন জানে না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার একবার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছে করে।
হঠাৎ রতন এক লাফে সামনের দিকে এগোয়। সঙ্গে-সঙ্গেই রিভলভারের “ফটাস” শব্দ হয়।
রতন বেকুবের মতো চেয়ে থাকে। সে ডাক্তারের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু ডাক্তার মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে আছে। রক্তের একটা পুকুর তৈরি হচ্ছে তার বুকের নিচে।