ডাক্তার সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এল। বাঞ্ছারাম জানেন এই ইনজেকশন মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে। কিছু বানিয়ে বলার ক্ষমতা থাকে না মানুষের। এই ইনজেকশন শরীরে ঢুকলে তিনি আর কিছুই করতে পারবেন না। তবু উপায় নেই। হাত পা শক্ত করে বাঁধা। বাঞ্ছারাম চোখ বুজে প্রাণপণে নিজের মনটাকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলেন। ডাক্তার সমস্তটুকু ওষুধ ছুঁচের মুখে ঠেলে দিল তাঁর শরীরে।
একটা হুইল চেয়ারে যখন ল্যাবরেটরিতে আনা হল বাঞ্ছারামকে, তখন তাঁর চোখ বিস্ফারিত। মুখ লাল। একটু হাঁফাচ্ছেনও।
বেঁটে লোকটা এগিয়ে এল তাঁর কাছে। তারপর আচমকা কষে একটা চড় মারল তাঁর গালে। তারপর প্রশ্ন করল, “আসল মাইক্রোফিল্মটা কোথায় বুড়ো ভাম?”
চড়টা টের পাননি বাঞ্ছারাম ওষুধের গুণে। কিন্তু প্রশ্নটা তাঁর মস্তিষ্কে গিয়ে ক্রিয়া করল। তিনি শান্তস্বরে বললেন, “ক্যাকটাস গাছের তলায়।”
“ক্যাকটাস গাছের তলায় যা পাওয়া গেছে, তা দেখবে? দ্যাখো।” বলে বেঁটে লোকটা একটা প্রজেকটারের সুইচ টিপল। সামনে একটা পর্দায় ফুটে উঠল আবছা একটা ছবি। হিজিবিজি মাত্র। বেঁটে লোকটা তার নিষ্ঠুর ঠাণ্ডা গলায় বলল, “এটা মাইক্রোফিল্মও নয়। একটা নষ্ট নেগেটিভের কাটা অংশ। এখন কী জবাবদিহি করবে?”
বাঞ্ছারাম দৃঢ় শান্তস্বরে বললেন, “মাইক্রোফিল্ম আছে ক্যাকটাসের তলায়।”
“নেই! নেই!” বলে চেঁচিয়ে ওঠে বেঁটে লোকটা। এই প্রথম উত্তেজিত, হতাশ এবং কুদ্ধ দেখায় তাকে। বাঞ্ছারামের দুটো কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতে-দিতে সে বলে, “সত্যি কথা বলো! নইলে খুন করে জলে ফেলে দেব।”
ডাক্তার এগিয়ে এসে বেঁটে লোকটার কাঁধে হাত রেখে বলে, “ডগলাস, এরকম কোরো না। ও যা বলছে সত্যি কথাই বলছে। টুথ ইনজেকশনের পর কোনো মানুষের পক্ষেই বানিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়।”
ডগলাস পাগলাটে চোখে ডাক্তারের দিকে চেয়ে বলে, “তাহলে কোথায় গেল মাইক্রোফিল্ম?”
এই প্রশ্নের জবাব এল সম্পূর্ণ অন্য অচেনা এক কণ্ঠ থেকে। “মাইক্রোফিল্ম আমার কাছে আছে।”
ডগলাস চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে, দরজার কাছে লম্বা গড়নের মজবুত ছিপছিপে চেহারার একজন ভারতীয় যুবক দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজ মাঝ-সমুদ্রে, চারিদিকে নিজস্ব লোকজন, তাই ল্যাবরেটরির দরজায় পাহারা রাখা প্রয়োজন মনে করেনি ডগলাস। এখন আচমকা ভূত দেখার মতো এই ছেলেটিকে আবির্ভুত হতে দেখে সে বিস্ময়ে হাঁ করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা হিসেবি গলায় বলল, “তুমি কে?”
রতন তার বাবাকে দেখিয়ে বলল, “আমি ওঁর ছেলে। ওঁকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
ডগলাস একটু কূর, শুকনো হাসি হেসে বলল, “ওয়েলকাম। কিন্তু কী করে এলে সেইটেই শুনতে চাই।” এই বলে ডগলাস একটু সরে এসে একটা টেবিলের পায়ায় লাগানো বোতামে চাপ দিল। চোখের পলকে দুজন লোক এসে হাজির হল দরজায়। তাদের চেহারা বিশাল এবং মুখ খুনির মতো ভয়ংকর। ডগলাস জ্ব কুঁচকে তাদের দিকে চেয়ে বলে, “তোমাদের মতো দক্ষ লোক থাকতেও এই ছেলেটি মাঝ-সমুদ্রে নোঙর করা একটা জাহাজে এসে উঠেছে। তোমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। এর জন্য তোমাদের জবাবদিহি পরে শুনব। আগে ছেলেটিকে সার্চ করো এবং দরজা বন্ধ করে বাইরে পাহারায় থাকো।”
সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল না। লোকদুটো শুকনো মুখে দরজা বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে।
ডগলাস স্থির দৃষ্টিতে রতনকে দেখছিল। তার বাঁ হাতে কখন যে জাদুবলে একটা ছোট্ট খেলনার মতো বাইশ বোরের রিভলভার উঠে এসেছে, তা কেউ টের পায়নি। এখন রিভলভারটা আবার কাঁধ থেকে ঝোলানো গুপ্ত হোলস্টারে রেখে ডগলাস একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বলল, “তুমি চালাক চতুর। খুবই বুদ্ধিমান। কী করে তুমি জাহাজে এসে উঠলে, তা পরে জানলেও চলবে। এখন বলো মাইক্রোফিল্মটা কোথায়।”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “সেটা এখনই বলতে পারছি না, ডগলাস। আমার বাবার মুক্তির পর বাড়ি ফিরে গেলে তবেই তা বলা যাবে।”
ডগলাস বিন্দুমাত্র চঞ্চল বা বিরক্ত হল না। খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তোমার বা তোমার বাবার মুক্তির কোনো প্রশ্নই আসে না। আমার চেহারাটা দেখে ভুল কোরো না। আমার বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কেউই কোনো লড়াই জেতেনি। তোমার মঙ্গলের জন্যই বলছি, মাইক্রোফিল্মের সন্ধানটা তোমার জানিয়ে দেওয়াই ভাল। নইলে আমাদের টর্চার চেম্বার আছে, টুথ ইনজেকশন আছে। তোমার তো মিলিটারি ট্রেনিং নেই, একটু বাদেই আমরা তোমার মুখ থেকে সত্যি কথাটা টেনে বের করে নেব। মাঝখানে খামোখা কেন কষ্ট পাবে?”
রতন থমকে গেল। সে টচার বা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথাটা ভেবে দেখেনি। টুথ ইনজেকশনের কথা সে আবছা শুনেছে। আমতা-আমতা করে সে বলল, “তুমি আমাদের ক্ষতি করতে চাও কেন? আমি তো বলছি মাইক্রোফিল্ম আমি দেব। শুধু আমার বৃদ্ধ বাবাকে ছেড়ে দাও। আমরা পুলিশকে কিছু জানাব না।”
ডগলাস আবার একটু হেসে বলে, “তোমাদের পুলিশকে আমার ভয় নেই। তবে আমাদের কয়েকজন প্রতিপক্ষ আছে। ভয়টা তাদের। কোনোভাবে খবরটা বাইরে যাক, তা আমরা চাই না। সুতরাং, ওহে যুবক, তুমি সাধ করে সিংহের ডেরায় ঢুকেছ। আমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা কোরো না। যদি ভালয়-ভালয় মাইক্রোফিল্মটা দিয়ে দাও, তাহলে কথা দিচ্ছি, তোমাদের মৃত্যু হবে যন্ত্রণাবিহীন।”