কিন্তু ভাল লড়াইয়ের জন্য প্রচণ্ড মনঃসংযোগ দরকার। বক্সিং-এ এক চুল ভুল, এক সেকেণ্ডের এক ভগ্নাংশের সময়ের হিসেবে গোলমাল একটুখানি চকিত সুযোগের অপব্যবহারও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। মন, চোখ, হাত, পা, মগজ সব তুখোড় সজাগ আর সচল রাখা চাই। বিশেষত সুব্বার মতো প্রতিপক্ষ যেখানে।
কিন্তু রতনের মনোযোগ আজ দুলছে। যে দুটো লোক রিং-এর পাশে চুপ করে বসে আছে, তাদের নিয়ে তার তেমন মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তবু সে কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করছে।
আর মিনিটখানেকের মধ্যেই লড়াই শুরু হবে। সুব্বা দু হাত তুলে দর্শকদের অভিনন্দনের জবাব দিচ্ছে। কালো স্পোর্টস প্যান্ট, কালো আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিতে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে সুব্বাকে। রতনের নিজের চেহারাও তেমন কিছু খারাপ নয়। তবে সুব্বার মতো ফর্সা নয় তার রং। অত টানা-টানা চোখও তার নেই। কিন্তু মেদহীন রুক্ষ শরীরে তার একটা ঝড়ো ভাব আছে। লড়াইয়ের সময় সে জেতার জন্য জান লড়িয়ে দিতে জানে। এইসব কারণে এই অল্প বয়সেই বক্সার হিসেবে তার কিছু নাম-ডাক হয়েছে। সেমি ফাঁইনালে সারভিসেসের একজন ঝানু বক্সারকে
সে পয়লা রাউণ্ডেই নক আউট করেছিল।
চিত্তব্ৰত সামান্য ম্লান হেসে বলল, “শোনো, প্রতিপক্ষ যত নামজাদাই হোক, দুনিয়ায় অপরাজেয় কেউ নেই।”
হঠাৎ রতন বলল, “চিত্তদা, ওই দুটো লোককে আপনি একটু নজরে রাখবেন। ওরা কেন সব জায়গায় আমার লড়াই দেখতে আসে তা জানা দরকার।”
চিত্তব্রত অবাক হয়ে বলল, “এক্ষুনি লড়াই শুরু হবে, আর তুমি এখন কে না কে দুটো লোকের কথা ভাবছ? আজেবাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে এখন কনসেনট্রেট করো তো! নইলে পয়লা রাউণ্ডেই ঘায়েল হয়ে যাবে। সুব্বা ইজ ট্রিকি, ভেরি ট্রিকি।”
শেষ ঘন্টা বাজল। রতন কাঁধ থেকে তোয়ালেটা ফেলে উঠে দাঁড়াল।
রেফারী মাঝখান থেকে সরে গেলেন। তারপরই চেঁচিয়ে বললেন, “ফাইট!”
রতনের চোখে আলোটা একটু ঝলসে উঠল কি? নাকি রেফারীর স্বর তার কানে একটু দেরিতে পৌঁছল? কিছু একটা গোলমাল হয়ে থাকবে। কারণ, রেফারীর চিৎকার শেষ হতে না হতেই বিদ্যুৎ-চমকের মতো, সাপের ছোবলের মতো, চাবুকের মতো তিনটে ঘুষি উপযুপরি নাড়িয়ে দিয়ে গেল তার চোয়াল, কপাল আর ডানদিকের কান।
মেঝের ওপর থেকে নিজের শোয়ানো শরীরটা যখন টেনে তুলছিল রতন, তখন তার কপালের কাটা জায়গাটা দিয়ে গরম রক্ত স্রোতের মতো নেমে এসে মুখ আর বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। ডান কানে একটি ঝিঝি পোকার ডাক। ডান চোখ রক্তে খুঁজে এসেছে। চোয়াল একদম লক জ’ হয়ে আটকে রয়েছে। হয়তো হাঁ করতে পারবে না, চেষ্টা করলেও।
রেফারী ছয় পর্যন্ত গুনে শেষ করেছেন। রতন তখন উঠে দাঁড়াল।
দর্শকরা সবাই চিৎকার করে আর হাততালি দিয়ে সুব্বাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
রেফারী মৃদুস্বরে রতনকে জিজ্ঞেস করলেন, “উড ইউ ফাঁইট অর রিটায়ার?”
রতন মাথা নাড়ল, গ্লাভস দিয়ে ডান চোখের রক্ত খানিকটা মুছে নিয়ে আড়ষ্ট চোয়ালে অতি কষ্টে উচ্চারণ করল, “ফাইট। ফাঁইট!”
“ফাইট?” বলে চেঁচিয়ে রেফারী সরে গেলেন।
ঘুষি খাওয়া বা রক্তপাত রতনের কাছে নতুন নয়। সে হতভম্ব হয়ে গেছে সুব্বার চকিত আক্রমণে। এত দ্রুত যে কারো হাত-পা চলতে পারে তা রতনের জানা ছিল না। সে বুঝল, সে যা। শুনেছিল, সুব্বা তার চেয়েও ভাল লড়িয়ে।
রতনের দ্বিধা আর অমনোযোগের যে ভাবটা ছিল, তা তিনটি ঘুষিতেই একদম কেটে গেল। যে দুটো লোককে দেখে সে অস্বস্তি বোধ করছিল, তাদের কথা আর তার মনেই রইল না। তার সামনে শুধু জেগে রইল রিং-এর ছোট্ট চৌহদ্দি আর তার মধ্যে দুর্ধর্ষ এক প্রতিপক্ষ।
নিয়ম হচ্ছে প্রতিপক্ষকে একবার ভাল করে মার জমাতে পারলে তারপর তাকে যথেচ্ছ মারা। তাকে আর থিতু হতে না দেওয়া, কেবল তাড়া করে যাওয়া। ফলে তার মনোবল ভেঙে যায়। সে হারে।
সুব্বাও তাই করতে চাইছিল। হয়তো ভেবেছিল সে প্রথম রাউণ্ডেই এই এলেবেলে লড়াইটা শেষ করে ড্রেসিং রুমে একটু জিরিয়ে নেবে।
কিন্তু মার খাওয়া রক্তাক্ত রতন চমৎকার পায়ের কাজে বাঁ দিকে সরে গিয়ে এবং ঠিক সময়ে মাথা সরিয়ে নিয়ে সুব্বার দু দুটো করাল ডানহাতি রাউণ্ডহাউস এড়িয়ে গেল।
সুব্বা ডান হাতে মারছে! তার মানে সুব্বার গার্ড নেই। অর্থাৎ জয় সম্পর্কে সে এতই নিশ্চিত যে, রতনের সম্ভাব্য প্রতি-আক্রমণের কথা সে মনেই ঠাঁই দেয়নি।
রতনের পিছিয়ে যাওয়া দেখে সুব্বা খুব সহজভাবেই এগিয়ে এসে দু হাতে কয়েকটা চকিত ওয়ান-টু চালাল তার মুখে। কোনোটাই লাগল না। রতন গ্লাভসে আটকে দিল।
রতন দড়ির ওপর ভর দিয়ে সুব্বার মার আটকাচ্ছিল যখন, সেই সময়ে পিছন থেকে কে যেন চাপা গলায় বলল, “লেফট! লেফট! হি হ্যাঁজ নো গার্ড।”
দৈববাণীর মতো সেই কণ্ঠস্বর কি চিত্তদার? কে জানে। কিন্তু রতন চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল, সুব্বার বাঁ দিকটা অরক্ষিত।
কিন্তু দড়ির ভর ছেড়ে উঠে মারতে যে সময় লাগবে ততটা সময় সুব্বা দেবে কি? মহম্মদ আলি জর্জ ফোরম্যানের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় রিং-এর দড়িকে খুব কাজে লাগিয়েছিল। স্কুল খেয়ে, সরে গিয়ে, দড়িটাকে স্প্রিং-এর মতো ব্যবহার করে আলি জিতেছিল সেই লড়াই। আর সেই কৌশলের নাম আলি নিজেই দিয়েছিল ‘রোপ এ ডোপ।