মাথাটা নামিয়ে নেয় রতন। তারপর নিচু হয়েই পর পর তিনটে ঘুষি পিস্টনের মতো চালিয়ে দেয় লোকটার মাথায়, নাকে আর থুতনিতে। তিনটেই মারাত্মক ঘুষি। গড়পড়তা যে-কোনো ভাল মুষ্টিযোদ্ধারও সহ্য করার কথা নয়। কিন্তু দানবটা তিনটে ঘুষিই হজম করল।
রতন বুঝল, দানবটা ক্যারাটে জানলেও বক্সিং খুব ভাল জানে। জানলে এই তিনটে ঘুষি খেত না বোকার মতো। তবে ঘুষি খেয়েও লোকটা দমেনি। একটু সতর্ক হয়েছে মাত্র। আগের মতো এগিয়ে এল না। দুটো মুগুরের মতো হাত মুঠো পাকিয়ে রতনের দিকে চোখ রেখে ঘুরতে লাগল।
রতন বুঝল, লোকটা সতর্ক হয়েছে। সুযোগ খুঁজছে। সেই সুযোগ ওকে দেওয়াটা বোকামি হবে। লোকটার একটা ঘুষিও যদি ঠিকমতো লাগে, তবে রতন সম্ভবত দু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।
রতন আস্তে করে এগিয়ে যায়। আত্মরক্ষার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় হল আক্রমণ। প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত নাজেহাল করে না। তুললে লড়াই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শুধু ভয়, এই লোকটা তো বক্সিংয়ের নিয়ম মেনে লড়বে না। দরকার হলে ক্যারাটের সাহায্য নেবে, পা চালাবে। তবু রতন সাপের মতো এগিয়ে গেল। পিছু হটতে গিয়ে দানবটা তার সঙ্গীর অচেতন দেহে পা ঠেকে টাল খেল। আর সেই মুহূর্তে রতন দু দুটো নক-আউট পাঞ্চ করল লোটার বাঁ চোখে আর ডান কানের একটু ওপরে।
দানবটা পড়ে গিয়েই স্প্রিং-এর পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল। তারপরই বিদ্যুৎ-বেগে ডান পা তুলে চালিয়ে দিল রতনের পেটে।
কিন্তু রতন তৈরিই ছিল। রোলোকে লাথি খেতে সে দেখেছে। কুঁজো হয়ে সে পেট সরিয়ে নিল। কিন্তু দু হাতে শক্ত ক্যাচ লোফার মতো চেপে ধরল দানবটার পায়ের গোড়ালি। জুডো খানিকটা সেও জানে। গোড়ালিটা চেপে ধরেই সে শরীর বাঁকিয়ে ঘুরে গেল উল্টো দিকে। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে দানবটাকে খানিকটা শুন্যে তুলে আছড়ে ফেলল মেঝেয়। স্তম্ভিত দানবটা তখনো চেতনা হারায়নি। পড়ে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে মাত্র। রতন বক্সিংয়ের নিয়ম ভেঙে নিচু হয়ে দানবটার মুখে পরপর দুটো ঘুষি মারল। ভারতের জাতীয় চ্যামপিয়নের এতগুলো একতরফা ঘুষি স্বয়ং মহম্মদ আলিকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দিত না নিশ্চয়ই। দানবটা তো মহম্মদ আলির একশো ভাগের এক ভাগও নয়। শেষ দুটো ঘুষিতে তার চেতনা লুপ্ত হল। হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রইল মেঝেয়। শান্ত, ঘুমন্ত।
“শাবাশ!” রতন একটু চমকে চেয়ে দেখে, জন উঠে বসে চেয়ে আছে তার দিকে। মুখে মৃদু হাসি। চোখে চোখ পড়তেই বলল, “শাবাশ!”
রোলোও আস্তে আস্তে দাঁড়িয়েছে। বোঝা গেল তার আঘাত গুরুতর নয়। কিন্তু জন! দানবটার ক্যারাটে চপ ওর কলারবোন ভেঙে দেয়নি তো?
জন মাথা নেড়ে বলল, “ভাঙেনি। তবে চোট মারাত্মক। আমি বাঁ হাত নাড়তে পারছি না। ঘাড়টাও স্টিফ লাগছে।”
“তাহলে?” রতন অসহায় ভাবে প্রশ্ন করে।
জন মৃদু ক্লিষ্ট হাসি হেসে বলে, “কিন্তু আমি অনেক মার খেয়েও শেষ পর্যন্ত যা করার তা ঠিকই করি। চলো, এখনো আসল কাজ বাকি। দরজার বাইরে বোধহয় একজন লোক পাহারা দিচ্ছে। তার ভার রোলোর ওপর ছেড়ে দাও। রোলো, তুমি আগে দরজা খুলে বেরোও।”
রোলো চকিত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা এক ঝটকায় খুলে ফেলল। তারপর বাইরে থেকে একটিমাত্র ঘুষির শব্দ পাওয়া গেল। তারপর একটি পতনশীল দেহের পাটাতনে আছড়ে পড়ার শব্দ।
জন ততক্ষণে মোড়ল আর দানবকে সার্চ করে একটা রিভলভার পেয়ে গেছে। সেটা পকেটে পুরে বলল, “চলো। এই জাহাজের প্ল্যান আমার মুখস্থ। ইন ফ্যাক্ট গ্রীসের যে ডকে এই জাহাজ তৈরি হচ্ছিল, আমি সেই ডক-এ কাজ করতাম। ফেবুলাস আমার চোখের সামনে জন্মায়।”
“তুমি ডকে কাজ করতে?”
“আমি সব রকম কাজ করেছি; বেঁচে থাকতে এবং বাঁচিয়ে রাখতে যত রকম কাজ সম্ভব, সবই করেছি। চলো রতন। আর সময় নেই।”
“চলো।” রতন দাঁতে দাঁত চেপে বলে।
৬. গভীর ঘুম থেকে
গভীর ঘুম থেকে যখন আস্তে-আস্তে চোখ মেললেন বাঞ্ছারাম, তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হল তাঁর। তাঁর সমস্ত চেতনা জাগ্রত। তাঁর বিস্মৃতি আর নেই। সব কিছুই তাঁর আশ্চর্য স্পষ্টভাবে মনে পড়ছে। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক। তাপ বিবর্ধক যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এমন কী এই কেবিনঘরটার কথাও তাঁর মনে পড়ল। এও বুঝতে পারলেন, কয়েকজন শয়তান লোক তাঁকে এখানে ধরে এনেছে।
বাঞ্ছারাম চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলেন। তারপর আবার চোখ মেললেন।
ডাক্তার এগিয়ে এল। “হ্যাঁলো, তুমি ভাল আছ?”
বাঞ্ছারাম চোখ মিটমিট করে বললেন, “আমি রসগোল্লা খাব।”
ডাক্তার হতাশার ভাব করে আপনমনে বলল, “আবার যে কে সেই। ঠিক আছে বুড়ো, আবার টুথ ইনজেকশনই তোমাকে নিতে হবে।”
বাঞ্ছারাম সবই বুঝতে পারছেন। যে-কোনো কারণেই হোক তাঁর পাগলামি সেরে গেছে, স্মৃতি ফিরে এসেছে। সে হয়তো মারধর খেয়ে, কিংবা এদের উল্টোপাল্টা ওষুধপত্রের ফলে। কিন্তু তা এরা জানে না। তাঁরও ধরা দেওয়া উচিত হবে না। বাঞ্ছারাম চোখ বুজে পড়ে রইলেন।
একটু বাদেই সেই বেঁটে লোকটা এল। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল, “রুগি কেমন?”
“একই রকম।”
“আমরা মাইক্রোফিল্মটা পেয়ে গেছি। এখন সেটা ডিসাইফার করতে হবে। ওকে আর একটু টুথ ইনজেকশন দাও। তারপর আমরা ওকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাব।”