অগত্যা তিনজনই হাত তোলে। তিনটে লোক তাদের সার্চ করে। কিছুই পাওয়া যায় না অবশ্য।
মোড়ল লোকটা ভ্রু কুঁচকে দেখছিল। সার্চ হয়ে গেলে অবহেলার গলায় বলে, “এদের সিক বে-তে নিয়ে যাও। ফরোয়ার্ড ডেকে।”
জন চারেক হোঁতকা নাবিক তাদের প্রায় ঘিরে ধরে নিয়ে চলল। অনেকটা পথ। লোহার সিঁড়ি দিয়ে দুইতলা নামতে হল। একতলা ফের উঠতে হল। অনেক গলিঘুজি পেরোতে হল। অবশেষে তারা পৌঁছল জাহাজের সামনের দিকে খোলের মধ্যে একটা জনহীন জায়গায়। একজন সাদা পোশাক পরা লোক ৭৬
এসে চাবি দিয়ে একটা দরজা খুলল। তিনজন ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল আবার।
রতন দেখে, তারা লম্বাটে একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো লোহার খাট সার বাঁধা। সেগুলোর পায়া মেঝের কাঠের তক্তায় নাট বল্ট দিয়ে আঁটা, যাতে জাহাজের দুলুনিতে সরে
যেতে পারে। ঘরটার মধ্যে বীজাণুনাশকের গন্ধ, যেমন গন্ধ হাসপাতালে পাওয়া যায়। দেয়ালে সারি-সারি কাবার্ড।
জন একটা খাটে বসে হাঁফ ছেড়ে বলে, “ও গড।” রতন এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি। কিন্তু জন ও রোলোর মুখে নিরুদ্বেগ ভাব দেখে সে বুঝতে পারে, এরকম বিপদ ওদের নিত্যকার সাথী। সে বলল, “এখন আমরা কী করব?”
জন মাথা নেড়ে বলে, “কিছু নয়। নৌকো সার্চ করে ওরা ফিরে আসুক। তারপর যা করার ওরাই করবে।”
“কী করবে?”
জন এ কথার জবাবে মৃদু হাসল শুধু। তারপর বলল, “ভয় নেই, সার্চ করে ওরা কিছুই পাবে না। আমাদের ইঞ্জিনও যথার্থই খারাপ। রোলো ইঞ্জিন খারাপ করার ওস্তাদ। সুতরাং এক্ষুনি আমাদের বিপদ নেই।”
তিনজন চুপচাপ বসে রইল।
অন্তত ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ পাওয়া গেল। ভিতরে এসে দাঁড়াল লম্বা-চওড়া লোকটা। সঙ্গে বিশাল আকৃতির এক দানব। দানবটা বিদেশী নয়। সম্ভবত ভারতীয়। তার চোখমুখ অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং খুনের মতো শীতল।
মোড়ল লোকটা বলল, “তোমাদের ইঞ্জিনের স্পার্ক প্লাগ খারাপ। কিন্তু আমাদের কাছে ওই মাপের প্লাগ নেই। দুঃখিত।”
বলে তাদের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইল লোকটা। তারপর মৃদু হেসে জনকে বলল, “তোমাদের দুজনের চোখের গগলসটা একটু রহস্যজনক। তোমাদের কি কনজাংটিভাইটিস হয়েছে?”
“হ্যাঁ।” জন বলল।
“রোগটা ছোঁয়াচে। আরো ছোঁয়াচে হল সন্দেহবাতিক।”
জন একটু ফুঁসে উঠে বলে, “তার মানে?”
লোকটা মৃদু হাসিমুখেই বলে, “আমার এই বন্ধুটি ভারতীয়। সে জানতে চাইছে তোমরা ভারতের কোন্ অঞ্চলের লোক।”
রতন এই সময়ে এক পা এগিয়ে গিয়ে বলে, “আমরা বাঙালি।”
“তোমার গগলস পরা বন্ধুরাও বাঙালি?”
একটু দ্বিধার গলায় রতন বলে, “হ্যাঁ।”
“আমার এই বন্ধু বাংলা জানে। তোমার বন্ধুদের একটু বাংলায় কথা বলতে বলল।”
জন চুপ করে বসে রইল। রতনও কী করবে ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। সন্দেহ যখন করেছে তখন শেষ দেখে ছাড়বে।
ঠিক এই সময়ে রোলো আস্তে উঠে দাঁড়াল। চোখের রোদচশমাটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে দুটো হাত ঘষাঘষি করে নিল একটু। তারপর রতনের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে একটা চোখ সামান্য ছোট করল। ইঙ্গিতটা বুঝে নিল রতন। আর দেরি নয়। অ্যাকশন।
রতন ব্যাঙের মতো একটা লাফ দিয়ে দরজার কাছে পৌঁছেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে রোলোর বাঁ হাতের একটা ঘুষি গিয়ে পড়ল মোড়লের চোয়ালে।
এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেল যে, প্রতিপক্ষ কিছু ঠাহর করার সময় পেল না। কিন্তু তারাও পেশাদার বখাটে। বিপদ-আপদ তাদেরও নিত্যসঙ্গী। ঘুষি খেয়ে মোড়ল লোকটা ছিটকে পড়লেও দানবটা তড়িৎগতিতে পিছু হটে গেল। তারপর আচমকা লম্বা একটা ঠ্যাং বাড়িয়ে রোলোর পেটে দুর্দান্ত একটা লাথি ঝাড়ল সে। লাথিটা পুরোপুরি এড়াতে পারেনি রোলো। কোঁক’ শব্দ করে সে উবু হয়ে বসে পড়ল মেঝেয়। দানবটা এক থাবায় জনকে ধরে দাঁড় করাল। তারপর ডান হাতে এত জোরে একটা ক্যারাটে চপ মারল যে, জনের কাঁধের হাঁড় হাতে ভেঙে যাওয়ার কথা। সেই মার খেয়ে জন চোখ উল্টে পড়ে গেল বিছানার ওপর। দানবটা এবার ঘুরে দাঁড়াল রতনের দিকে।
এতক্ষণ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া রতন আর কিছুই করেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। তাছাড়া এই দানবের সঙ্গে লড়ার জন্য অনেক ক্ষমতা থাকা দরকার। এ শুধু প্রচণ্ড শক্তিমানই নয়, ভাল ক্যারাটে জানে। নিশ্চিত একজন ব্ল্যাক বেল্ট।
দানবটার চোখে চোখ রেখে রতন লোকটাকে মেপে নিচ্ছিল। অন্তত ছ’ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা। মেদহীন পেটানো শরীর। অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং বিপজ্জনক।
রতনের অবশ্য তাতে ভয় নেই। সে অনেক লড়াই করেছে। তার ওপর বাবার জন্য উদ্বেগে সে এখন মরিয়া।
দানবটাও তাকে মেপে নিল একটু। তারপর লম্বা ডান হাতটা বাড়িয়ে তার গলাটা চেপে ধরার চেষ্টা করল। রতন প্রস্তুত ছিল। চট করে সরে গেল বাঁ দিকে। তারপর শরীরের ভারসাম্য রেখে বাঁ হাতে একটা বিষ মেশানো পাঞ্চ চালাল দানবের মুখে। ঘুষিটা ৮০
সোজা গিয়ে চোয়ালে বোমার মতো ফাটল।
অন্য কেউ হলে এক ঘুষিতেই জমি ধরে নিত। কিন্তু দানবটা যেন কংক্রিটে তৈরি। একটু টলল বটে, কিন্তু নড়ল না। ফিরে লম্বা বাঁ হাতে সেও একটা কামানের গোলার মতো ঘুষি চালাল রতনের মাথায়।