রতন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কী করব?”
জন বলে, “আমাদের লোকসংখ্যা মাত্র তিনজন। মুখোমুখি আমরা পারব না। তবে আমি একটা স্পীডবোটের ব্যবস্থা করেছি। জাহাজটা কোথায় আছে তারও খোঁজ নিয়েছি। আমরা জাহাজটার কাছাকাছি পৌঁছে মোটরবোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেব। তারপর বেতার সংকেতে একটা এস ও এস পাঠাব ওই জাহাজে। বলব যে, আমরা বিপন্ন, আমাদের উদ্ধার করো।”
“ওরা তা করবে?”
জন মৃদু হেসে বলল, “করবে। দুটো কারণে। আমরা সন্দেহজনক লোক কিনা তা জানার জন্য। দ্বিতীয়ত, ওই জাহাজের সবাই মাফিয়া নয়।”
“কিন্তু তারপর?”
“তারপর দেখা যাবে। আগে তো জাহাজে উঠি।”
“তুমি মস্ত ঝুঁকি নিচ্ছ জন।”
“ঝুঁকি নেওয়াই আমার অভ্যাস।”
রতন আর কথা বলল না।
তারা যখন ক্যানিং পৌঁছল তখনো রাতের অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। সরু রাস্তা বেয়ে কুয়াশার মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে জন আর রোলোর পিছুপিছু একটা আঘাটায় নেমে চমৎকার ছোট্ট একটা স্পীডবোটে উঠল রতন। উঠতে না উঠতেই বোট ছেড়ে দিল রোলো।
কোথায় যাচ্ছে, রতন জানে না। কিন্তু জন বা রোলোর কোনো ভাবান্তর নেই। রোলো বোট চালাচ্ছে আর জন একটা ম্যাপ আর কম্পাস নিয়ে বসে আছে। কারো মুখে কথা নেই।
ভোর-ভোর একটা আভা যখন আকাশে ফুটে উঠেছে, তখন জন একটা অদ্ভুত ধরনের দূরবিন তুলে চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগল। কী দেখল সে-ই জানে। মৃদু স্বরে বলল, “স্পীড কমাও, এস ও এস পাঠাতে থাকো।”
রতন তার চারধারে সমুদ্রের বিপুল কালো জলরাশি দেখতে থাকে। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে ফিরে যাওয়ার আশা তাদের খুবই কম। তবু এখন এখন নিজের চেয়ে তার বাবার কথাই বেশি ভাবছে রতন। ভাবছে বুড়ি পিসিটার কথাও। সে আর তার বাবা যদি এদের হাতে খুন হয়, তবে পিসিকে দেখার কেউ থাকবে না।
জন হঠাৎ দূরবিনটা রতনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “দ্যাখো, আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।”
রতন দূরবিনটা চোখে লাগাল। আশ্চর্য দূরবিন। কুয়াশা এবং অন্ধকার ভেদ করে অনেক দূর পর্যন্ত তা দিয়ে দেখা যায়। সে দক্ষিণ দিকে অনেকটা দূরে প্রকাণ্ড কালো জাহাজটাকে দেখতে পেল। রতন জিজ্ঞেস করে, “এটা কী রকম দূরবিন জন?”
“ইনফ্রা রেড দূরবিন। শোনো, একটু বাদেই আমাদের এস ও এস জাহাজে পৌঁছবে। সম্ভবত ওরা জল থেকে তুলে নেবে আমাদের। তারপরই শুরু হবে খেল। মাথা ঠাণ্ডা রেখো। বন্দুক পিস্তল দেখে ঘাবড়ে যেও না। আমার কাছে যে সাব-মেশিনগান আছে তা সঙ্গে নেওয়ার উপায় নেই। কারণ ওরা আমাদের জাহাজে তুলেই সম্ভবত সার্চ করবে। সাব-মেশিনগান সঙ্গে থাকলে ওরা সঙ্গে-সঙ্গেই আমাদের জলে ফেলে দেবে। সুতরাং নিরীহ ভাল মানুষের মতো নিরস্ত্র অবস্থায় আমরা শত্ৰুপুরীতে ঢুকছি। অস্ত্রের বিরুদ্ধে, সংঘবদ্ধ হিংস্রতার বিরুদ্ধে আমাদের একমাত্র সম্বল বুদ্ধি আর ঠাণ্ডা মাথা। মনে রেখো।”
ইঞ্জিন বন্ধ করে ধীরে-ধীরে ঢেউয়ে দোল খেয়ে-খেয়ে স্পীডবোট জাহাজের দিকে এগোতে লাগল। যত এগোয়, তো বুক দুরদুর করে রতনের। অস্থির বোধ করে সে। কিন্তু জন আর রোলোর ভাবান্তর নেই। আজ পর্যন্ত রোলোকে একটিও কথা বলতে শোনেনি রতন। অথচ ওকে বোবা বলেও মনে হয় না।
জাহাজটা যে কত বড়, কাছাকাছি এসে তার খানিকটা আন্দাজ পেল রতন। একটা মস্ত দুর্গও তার মধ্যে এঁটে যায়। এম এস ফেবুলাস সত্যিই ফেবুলাস।
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল, ওপরের ডেকে কয়েকজন লোক সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই ওপর থেকে একটা দড়ির মই নেমে এল। রোলো স্পীডবোটের ছাদে উঠে মইটাকে ধরল, তারপর প্রথমে জন আর পিছনে রতন আস্তে-আস্তে মই বেয়ে উঠতে লাগল। তার পিছনে রোলো। সমুদ্রে হাওয়া নেই, তবু মইটা দোল খাচ্ছে। আর কত ওপরে যে উঠে যাচ্ছে তারা! দশতলা বাড়ির চেয়েও উঁচু বুঝি জাহাজটা!
ডেকের কাছাকাছি পৌঁছতেই শক্ত বলবান কয়েকটা হাত তাদের টেনে তুলে নিল ওপরে।
জন হাঁফাচ্ছিল। কিন্তু কঠিন পরিশ্রমে অভ্যাস আছে বলে রতন বা রোলোর হাঁফ ধরেনি। কিন্তু গায়ে মোটা পুলওভার থাকা সত্ত্বেও শীতে কাঁপছিল রতন। জন এবং রোলো শীতের দেশের লোক। পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর দুজনেরই জহর কোট মাত্র পরা। তবু তাদের শীত লাগছিল না।
ডেকের ওপর কর্কশ এবং শক্তসমর্থ চেহারার কয়েকজন নাবিক দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই বিদেশী। তাদের মধ্যে একটু লম্বাচওড়া চেহারার একজন বোধহয় একটু উচ্চপদস্থ। সে জন-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের বিপদটা কী ধরনের?”
জন বলল, “আমাদের মোটরবোটের ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে। সারানোর যন্ত্রপাতি সঙ্গে নেই। আমরা সাহায্য চাই।”
মোড়ল গোছের লোকটা বিরক্তির সঙ্গে বলল, “তুমি যা বলছ তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। টুল বক্স ছাড়া কোনো বোকাও সমুদ্রে বেরোয় না।”
“আমরা ভুলে টুল বক্স ফেলে এসেছি।”
লোকটা তেমনই তিক্ত স্বরে বলে, “ঠিক আছে, আমাদের একজন মেকানিক গিয়ে তোমাদের যন্ত্র পরীক্ষা করবে। তোমরা ভিতরে যাও। যদি কোনো চালাকি করতে এসে থাকো, তাহলে মুশকিল হবে।”
জন দৃঢ়স্বরে বলে, “আমাদের কোনো খারাপ মতলব নেই।”
“দেখা যাবে। এখন হাত তুলে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের সার্চ করব।”
জন বিস্ময়ের ভান করে বলে, “সার্চ করবে? কেন, আমরা কি ডাকাত?”
“কে জানে! আমরা ঝুঁকি নিতে চাই না। হাত তোলো।”