এসব হেঁয়ালির কোনো মাথামুণ্ডু বুঝল না রতন। সে গিয়ে তার বুড়ি পিসিকে জিজ্ঞেস করল, “পিসি, বাবা কোনো জিনিস লুকোতে হলে কোথায় লুকোতে পারে বলো তো?”
পিসি ভাইয়ের জন্য কেঁদেকেটে শয্যা নিয়েছে। বলল, “কী জানি বাছা। কী লুকোবে বল্ তো?”
“দশ-বারো বছর আগে বাবা একটার ফরমুলা লুকিয়ে রেখে তারপর সে কথা ভুলে যায়।”
পিসি অনেক ভেবেচিন্তে বলে, “সে তো অনেকদিন হয়ে গেছে।”
“তুমি তো বাবার সব কিছু জানো, আর এটা মনে করতে পারছ?”
পিসি বলল, “কিছু কিছু মনে আছে। বাঞ্ছ তখন একটা ভারী ক্যামেরা দিয়ে কাগজপত্রের ছবি তুলত। রাত জেগে জেগে রোজ ঐসব করত বলে কত বকেছি। তারপর সেইসব কাগজপত্র আগুনে পুড়িয়ে দিত। ঘর নোংরা হত।”
উত্তেজিত হয়ে রতন বলে, “সেই ক্যামেরাটা কোথায়?”
“কবে বিক্রি হয়ে গেছে।”
“আর ফোটোগুলো?”
“সে তো বাঞ্ছার পাগলামি। জন্মে শুনিনি বাবা কেউ কাগজের ফোটো তোলে।”
“আর কিছু করতে দেখোনি বাবাকে?”
“তা দেখব না কেন? কোনোদিন তার গাছপালার শখ ছিল না। পাগল হওয়ার আগে হঠাৎ তার টবে গাছ করার বাই চাপল। হাঁড়িকুড়ি যা পেত, তাতেই মাটি ভরে গাছপালা লাগাত। তার জন্যেও আমার কাছে বকুনি খেয়েছে।”
“গাছ? কিসের গাছ?”
“কত রকমের। সবই আগাছা।” রতন খুব হতাশ হল। সে জানে, জনের কথামতো যদি সত্যিই মাফিয়ারা ফরমুলার সন্ধানে আসে আর যদি সেটা সহজে খুঁজে না পায় তাহলে বাড়ির কাউকে ছেড়ে দেবে না। পুলিশকে খবর দিয়ে লাভ নেই। পুলিশ আজ তাদের রক্ষা করলেও রোজ তা পারবে না। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই ফরমুলাটা খুঁজে পাওয়া দরকার।
রতন জিজ্ঞেস করে, “পিসি, সেই গাছের টবগুলো কোথায় আছে জানো?”
“সে-সব করে ফেলে দিয়েছি।”
“কোথায় ফেলেছে মনে আছে?”
“পিছনে জঙ্গুলে জমিটায়। কেন, সেগুলো দিয়ে এখন কী করবি?”
“কাজ আছে।” বলে রতন উঠে গেল।
বাড়ির পিছন দিকে অনেকটা জমি তাদের। এক সময়ে সজির বাগান ছিল। এখন অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে। বুক-সমান উঁচু আগাছা। সাপখোপ সবই থাকতে পারে। রতন একটা ভোজালি দিয়ে গাছপালা সাফ করতে লাগল। প্রায় তিন-চার ঘন্টা পরিশ্রমের পর অবশেষে একদম বাগানের শেষ প্রান্তে দেওয়াল ঘেঁষে গোটা দশেক ভাঙা হাঁড়ি আর টব দেখতে পেল সে। গাছগুলো কবে মরে গেছে। শুধু একটা ক্যাকটাস আজও ধুকধুক করে বেঁচে আছে কোনোক্রমে।
“কাঁটা হেরি” কথাটা ঝট করে মনে পড়ে গেল রতনের। সে হাঁড়ি থেকে ক্যাকটাস গাছটাকে টেনে বের করে আনল। হাঁড়িটা ভেঙে গেল, আর ক্যাকটাসের সঙ্গে গোল মাটির চাপড়া উঠে এল। সেই মাটির ডেলার সঙ্গে সবুজ রঙের একটা প্লাস্টিকের মোড়ক।
কাঁপা হাতে মোড়ক খুলে রতন দেখে, তার মধ্যে খুব ছোট্ট একটা নেগেটিভ ফিল্মের টুকরো। সযত্নে পার্চমেন্ট কাগজে মোড়া।
আর-একটা হাঁড়ি যোগাড় করে তাতে সেই প্ল্যাস্টিকের মোড়ক সমেত ক্যাকটাসটাকে লাগিয়ে ভিতরের বারান্দায় রেখে দিল রতন। খানিকটা নিশ্চিন্ত। তারপর দরদালানে ঘুষি মারা বস্তায় অনেকক্ষণ ধরে ঘুষি চালিয়ে শরীর গরম করে নিল। সব অবস্থার জন্যই নিজেকে তৈরি রাখা দরকার।
জন আর রোলো ফিরল দুপুর গড়িয়ে। তারা একটা গাড়ি সঙ্গে করে এনেছে।
জন বলল, “সম্ভবত আমাদের সমুদ্রযাত্রা করতে হবে। অবশ্য দ ডগলাসের লোকেরা এ বাড়িতে হানা দেয়। তা না হলে আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না। ধরে নিতে হবে যে, ওরা ফরমুলা পেয়ে গেছে এবং তোমার বাবাকেও মেরে ফেলেছে।”
রতন বলল, “ওরা ফরমুলা পায়নি।”
“কী করে জানলে?”
রতন কিছুই গোপন করল না। জন সব শুনে বলল, “রতন, বক্সাররা একটু নির্বোধ হয়। আমরা বলি পাঞ্চ-ড্রাঙ্ক। ঘুষি খেয়ে খেয়ে তাদের ব্রেন সূক্ষ্মতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু তুমি খুবই বুদ্ধিমান।”
রতন একটু হাসল মাত্র।
সন্ধের পর জন ও রোলো আশ্রয় নিল গবেষণাগারে। রতন তার ঘরের জানালা ফাঁক করে বসে রইল। ক্রমে সন্ধে গড়িয়ে রাত্রি হল। রাত্রি নিশুত হতে চলল। জানালার ফাঁক দিয়ে রতন ভেতরের বারান্দাটা দেখতে পাচ্ছিল। হাঁড়ির ক্যাকটাস গাছটাও।
থানার ঘড়িতে রাত দুটো বাজার ঘন্টি পড়ল। নিশুতি নিঃঝুম রাত চিরে একটা কুকুর ভুক-ভুক করে উঠল কাছেপিঠে। একটা বেড়াল ডাকল।
চেয়ে থাকতে থাকতে রতনের চোখ টনটন করছিল। হাই উঠছিল বার বার। এক সময়ে সে হয়তো ঘুমে একটু চুলেও পড়েছিল। হঠাৎ টানটান হয়ে বসে সে তীক্ষ্ণ চোখে চারদিক নজর করতে লাগল। কোনো শব্দ হয়নি। অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে একটা বিপদের গন্ধ ধরা পড়েছে।
অল্প জ্যোৎস্না আছে আকাশে। তারই আবছা আলোয় সে দেখতে পেল, কালো পোশাক পরা দুই মূর্তি নিঃশব্দে উঠোনের পাঁচিলে উঠে দাঁড়াল। তারপর শব্দহীন লাফে নেমে এল ভিতরে। চকিত এবং নিঃশব্দ তাদের গতিবিধি। চোখের পলকে তারা ক্যাকটাস গাছটাকে তুলে ফেলল হাঁড়ি থেকে। কয়েক মুহূর্তে বের করে ফেলল সেই মোড়ক। আবার নিঃশব্দে দেওয়াল টপকে চলে গেল।
রতন দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই তার কাঁধে হাত রাখল জন। মৃদু স্বরে বলল, “তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ওরা যাবে ক্যানিং। আমি জানি। তুমি তৈরি তো?”
“হ্যাঁ।”
“চলো।” দুজন চোরের মতোই দেয়াল ডিঙিয়ে তারা পিছনের পোড়ো জমিটায় নামল। বাগানের বাইরে জনের গাড়ি দাঁড় করানো। স্টীয়ারিং হুইল ধরে রোলো বসে আছে। তারা উঠতেই গাড়ি বিদ্যুৎবেগে নিশুত রাতের ফাঁকা রাস্তা ধরে দৌড়োতে লাগল।