বেঁটে লোকটা হাসল। বলল, “তাই হবে, বৈজ্ঞানিক। আমরা তোমার মাইক্রোফিল্ম এনে দেব। তারপর তুমিই সেই সংকেত উদ্ধার করবে।”
“তারপর কী হবে? তোমরা ভাল লোক নও। আমি সংকেত ভেঙে দেওয়ার পর তোমরা নিশ্চয়ই আমাকে জীবিত রাখবে না।”
বেঁটে লোকটা চোখের ইশারা করে। ডাক্তার বাঞ্ছারামকে আর-একটা ইনজেকশন দেয়। বাঞ্ছারাম ঘুমিয়ে পড়েন।
৫. জন সব কথা মন দিয়ে শুনল
জন সব কথা মন দিয়ে শুনল। তারপর মাথা নেড়ে ম্লান হেসে বলল, “আমি যাদের সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম এরা বোধহয় তারাই।”
রতন উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে, “কারা?”
জন বলল, “এরা সি-আই-এ বা কে-জি-বি নয়। এরা কোনো বিশেষ রাষ্ট্রের লোকও নয়। তবে এদের ঘাঁটি অ্যামেরিকায়। পৃথিবীর কয়েকজন কুখ্যাত ধনী ব্যক্তির এক দুষ্টচক্র। রাব্বি এদের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খেতে গিয়েছিল। তারপর একদিন সে হাপিস হয়ে যায়। এই দুষ্টচক্রের ক্ষমতা অসীম। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গুণ্ডা সংগঠন মাফিয়া এদের হাতের মুঠোয়। এদের এত টাকার জোর, যার বলে এরা যে-কোনো রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র অচল করে দিতে পারে, যে-কোনো পুলিশবাহিনীকে রাতারাতি কিনে নিতে পারে। হিট অ্যামপ্লিফায়ারের ফরমুলা হাতে পেলে তার আন্তজাতিক পেটেন্ট কিনে নেবে। তারপর শুরু করবে একচেটিয়া ব্যবসা। আরো একটা ভয় আছে। হিট অ্যামপ্লিফায়ার যন্ত্রটা তো শুধু মানুষের উপকারই করবে না। তাই দিয়ে মারাত্মক অস্ত্র তৈরি করাও সম্ভব।”
রতন আচমকা বলল, “কিন্তু তোমরাও তো যন্ত্রটা হাত করতে চাইছ। তোমরাই বা এটা নিয়ে কী করবে?”
জন বলে, “আমাদের কুমতলব নেই। আগেই তোমাকে বলেছি, আমি তৃতীয় বিশ্বের লোক। আমার দল গরিব দেশগুলির বন্ধু। আমরা সন্ত্রাসবাদী বটে, কিন্তু আমাদের লড়াই ধনী ও ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে। ওরা আমাদের ঘৃণা করে, মানুষ বলে মনে করে না। সেই তৃতীয় বিশ্বের একজন বৈজ্ঞানিকের এই মহামূল্যবান আবিষ্কারকে আমি বা আমরা বেহাত হতে দিতে চাই না। এই যন্ত্র একদিন তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে শক্তিশালী দেশগুলির সম্পদ ও ক্ষমতার পার্থক্য ঘুচিয়ে দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাই আমি চেয়েছিলাম ফরমুলাটা আমাদের হাতে থাক।”
রতন উদ্বেগের সঙ্গে বলে, “কিন্তু আমার বাবার কী হবে?”
জন চিন্তিত স্বরে বলে, “যদি ওরা ইতিমধ্যে ফরমুলাটা হাতে না পেয়ে থাকে তবে তোমার বাবাকে ওরা মারবে না। কাজেই আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।”
“আমার বাবাকে ওরা কোথায় নিয়ে গেছে জানো?”
“আন্দাজ করতে পারি। বঙ্গোপসাগরে একটা গ্রীক জাহাজ নোঙর ফেলে আছে। জাহাজটার নাম এম এস ফেবুলাস। মস্ত জাহাজ। সম্ভবত তাতে।”
“আমরা কি সেই জাহাজটার কথা পুলিশকে জানাব?”
জন বলে, “তুমি বোকা। কোনো পুলিশ বা আর কারো সাধ্য নেই কিছু করার। তাছাড়া পুলিশের এক্তিয়ারও অতদূর নয়। ধৈর্য ধরো। আমার ক্ষীণ আশা, ওরা ফরমুলাটা এখনো পায়নি। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে ওরা আবার এখানে হানা দিতে আসবে। তখন আমরা ওদের পিছু নেব।”
“ওরা কতজন?”
জন হাসল। “ওরা সংখ্যায় অনেক। তবে জাহাজের মাঝি মাল্লা সবাই মাফিয়া নয়। তারা বোধহয় জানেও না, জাহাজটার খোলের অসংখ্য কেবিনে কী কাণ্ড হচ্ছে। তবু বলি, সংখ্যায় ওরা কম নয়, দুর্বল তো নয়ই। ওদের মেলা বন্দুক পিস্তল আছে। আমাদের সম্বল তোমার আর রোলোর ঘুষির জোর। আমার কাছে একটা ছোট্ট সাব-মেশিনগান মাত্র আছে। কিন্তু ওদের অস্ত্রবলের সামনে সেটা নস্যি। কাজেই গায়ের জোরে কাজ হবে না। বুদ্ধির জোরই আসল। শোনো রতন, আমি আর রোলো আপাতত এখানেই আস্তানা নিচ্ছি। আমাদের সাদা চামড়া খুবই চোখে পড়ার মতো। কিন্তু আমাদের কাছে কৃত্রিম গায়ের রং আছে। বিদেশে মেয়েরা গায়ের চামড়া ট্যান করার জন্যে এই রং মাখে। আমি আর রোলো সেই রং মেখে ইণ্ডিয়ান হওয়ার চেষ্টা করব। তুমি শুধু আমাদের দুটো পাজামা আর পাঞ্জাবি যোগাড় করে দাও।”
রতন মাথা নেড়ে ভিতরবাড়িতে গিয়ে পাজামা আর পাঞ্জাবি নিয়ে এসে যখন ফের ল্যাবরেটরিতে ঢুকল, তখন জন আর রোলো প্রায় ভারতীয় সেজে বসে আছে। দুজনেরই চোখে গগলস। পাজামা পাঞ্জাবি পরার পর দুজনেই খাঁটি ভারতীয় বনে গেল। চুলগুলিও ইতিমধ্যে কলপ লাগিয়ে কালো করে নিয়েছে।
ভোর হয়ে এসেছে। জন বলল, “রতন, ওরা আজ যে-কোনো সময়ে এসে হাজির হবে। চারদিকে লক্ষ রেখো। ওরা এলে বাধা দিও না। আমার মনে হয়, ওরা আসবে আজ গভীর রাতে। তুমি দিনের বেলা যতটা পারো, ঘুমিয়ে নাও। আমি আর রোলো বেরোচ্ছি। কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। দুপুরের মধ্যেই আমরা ফিরে আসব।”
রতন অবশ্য ঘুমোল না। ঘুমোনোর মতো মনের অবস্থা নয়। বাবার জন্য উদ্বেগ আর তীব্র উত্তেজনায় সে অস্থির। জন আর রোলো চলে যাওয়ার পর সে খুব সাবধানে সারা বাড়ি সার্চ করল। কোথাও কিছু পেল না। তবে বাবার ঘরের স্টীলের আলমারিতে সে বাবার কয়েকটা পুরনো ডায়েরি খুঁজে পেল। বেশির ভাগ ডায়েরিতেই কোনো রোজনামচা নেই, কেবল কিছু বৈজ্ঞানিক আঁক কষা আছে। তবে একটা ডায়েরিতে সে কিছু বাংলা লেখা খুঁজে পেল। এগারো বছর আগেকার এক ডিসেম্বর মাসে বাবা লিখেছেন : জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না! রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই কথাটুকুর পাশে ব্র্যাকেটে লেখা : “কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে? যেখানে দেখহ ছাই উড়াইয়া দেখ তাই। মিলিলে মিলিতে পারে অমূল্য রতন।”