বাঞ্ছারাম ডুকরে উঠে বললেন, “আমি দিদির কাছে যাব।”
বেঁটে লোকটা হাসল। বলল, “পুরুষ মানুষের মতো আচরণ করো। তোমরা ভারতীয়রা এত কাপুরুষ কেন?”
“আমাকে মেরো না।”
“মারতে চাইছি না। তোমার চিকিৎসাই করতে চাইছি। কিন্তু কাজটা একটু বিপজ্জনক। তাতে তোমার মৃত্যু ঘটতে পারে। আর যদি ঘটেই তবে তা বীরের মতো মেনে নিও।”
“আমি রসগোল্লা খাব। মরতে আমার একটুও ইচ্ছে করে না।”
বেঁটে লোকটা ডাক্তারের দিকে চাইল। বলল, “এবার টুর্থ ইনজেকশনটা দাও। আমার মনে হচ্ছে ওর পাগলাটে মনের কোনো লুকনো ঘরে সেই স্মৃতি আজও আছে। একটু দাঁড়াও। দেখি ও রাব্বিকে চিনতে পারে কি না।”
লোকটা একটা বোম টিপল। একটা লোক হাজির হতে তাকে মৃদুস্বরে কী নির্দেশ দিল।
একটু বাদেই চারজন তোক একজন বুড়োমানুষকে টেনে নিয়ে এল ঘরে। তার চুল সাদা এবং কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। শরীর রোগা।
চোখে জুলজুলে চাউনি। তাকে বাঞ্ছারামের সামনে দাঁড় করানো হলে বেঁটে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “একে চিনতে পারো?”
“না।”
“এ হল রবিন ফরডাইক। হিট অ্যামপ্লিফিকেশনের কাজে এ তোমাকে সাহায্য করত। তারপর তোমার কাগজপত্র চুরি করে নিয়ে পালায়। যাওয়ার আগে ওষুধ দিয়ে তোমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দিয়ে যায়। এর ইচ্ছে ছিল, হিট অ্যামপ্লিফায়ার তৈরি করে দুনিয়া জুড়ে ব্যবসা করবে। আমরা ওকে লক্ষ লক্ষ ডলার দিয়েছিলাম এই আশায় যে, ও তাপ-পরিবর্ধক তৈরি করে আমাদের এজেন্সি দেবে। আমাদের মতো আরো কয়েক হাজার লোককে ঠকিয়ে ও এখন বহু টাকার মালিক। কিন্তু ও জানত না, পৃথিবীর সব জায়গায় আমাদের হাত গিয়ে পৌঁছোয়। কী, চিনতে পারছ?”
বাঞ্ছারাম চেয়ে থাকেন। স্মৃতি টলমল করে। কুয়াশা যেন একটু কেটে যায়। রবিন ফরডাইক! এ যেন পূর্বজন্মে শোনা একটা নাম।
ফিসফিস করে বাঞ্ছারাম বললেন, “রবিন! রবিন! এত বুড়ো হয়ে গেছ?”
রবিন কিছু বলল না। বলার মতো অবস্থাও নয়। বেঁটে লোকটা তার হয়ে জবাব দিল, “না, বুড়ো হয়নি। তবে ওকে আমরা পাকিয়ে বুড়ো করেছি। শোনো বাঙালি বৈজ্ঞানিক, তোমার অবস্থা রবিনের চেয়েও খারাপ হতে পারে। এখনো মনে করার চেষ্টা করো, সেই ফরমুলাটা কোথায় আছে। রবিন জানে, তুমি শেষ পর্যন্ত হিট অ্যামপ্লিফায়ার তৈরি করার পদ্ধতি বের করেছিলে। কিন্তু ফরমুলাটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছ। আমরা জানতে চাই, কোথায়।”
বাঞ্ছারাম নিজেও তা ভুলে গেছেন। প্রাণপণে চোখ বুঝে মনে করার চেষ্টা করলেন। পারলেন না।
বেঁটে লোকটা ডাক্তারের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বলল, “এবার টুথ ইনজেকশন দাও।”
বিনা বাক্যে ডাক্তার একটা সিরিঞ্জ ভরে নিয়ে এগিয়ে আসে।
ইনজেকশন দেওয়ার পর কিছুক্ষণ অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় ছটফট করলেন বাঞ্ছারাম। তারপর আস্তে-আস্তে স্থির হয়ে গেলেন। চোখদুটি বিস্ফারিত। মুখ ফ্যাকাসে। ঠোঁটের কোণে ফেনা। অল্প-অল্প হাঁফাচ্ছেন।
মিনিট দশেক পরে বেঁটে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “বলো ভারতীয় বৈজ্ঞানিক, তুমি কি সত্যিই পাগল?”
বাঞ্ছারাম শান্ত স্বরে চোস্ত ইংরিজিতে বললেন, “না। আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল। মাঝে-মাঝে আমি বয়স হারিয়ে ফেলি। বার্ধক্যের সঙ্গে শৈশব গুলিয়ে যায়। কিন্তু সেটা মস্তিষ্কের কোনো
জটিল অসুখ নয়।”
“এখন তোমার স্মৃতিশক্তি কেমন কাজ করছে? দশ বারো বছর আগেকার কথা মনে পড়ছে?”
“পড়ছে। আমি তখন হিট অ্যামপ্লিফিকেশন নিয়ে গবেষণা করতাম। রবিন ফরডাইক আমাকে সাহায্য করত। অবশেষে একদিন আমি সাফল্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। আমি
জানতাম আমার আবিষ্কার অত্যন্ত মূল্যবান। এও জানতাম, আমার আবিষ্কার আমার সহকারি রাব্বি না রবিন যথেষ্ট বুদ্ধিমান বটে, কিন্তু তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। শেষ দিকে আমি তাই দুরকম লগবুক লিখতে লাগলাম। আমার আসল গবেষণার রিপোর্ট আমি মাইক্রোফিল্মে তুলে কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলতাম। ল্যাবরেটরিতে রাখতাম একটা ভুয়ো রিপোর্ট। কিন্তু বুদ্ধিমান রবিন তবু টের পেয়েছিল যে, আমি সাফল্যের দরজায় পৌঁছেছি। তাই সে একদিন আমার গবেষণাগারের কুঁজোর জলে ওষুধ মেশায়। সেটা খেয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার স্মৃতিশক্তি ও স্বাভাবিক চিন্তার ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়।”
বেঁটে লোকটা অধৈর্য হয়ে বলে, “সেকথা থাক। এখন বলল, সেই মাইক্রোফিল্মটি কোথায় আছে।”
“ফিল্ম আছে একটা প্ল্যাস্টিকের মোড়কে। আমি সেটা একটা রসগোল্লার হাঁড়িতে রেখেছিলাম।”
বেঁটে লোকটা দানবটাকে জিজ্ঞেস করল, “রসগোল্লার মানে কী?”
দানবটা বুঝিয়ে বলল। বেঁটে লোকটা ভ্রু কুঁচকে বলল, “ওরকম মূল্যবান জিনিস একটা মাটির পাত্রে রাখা কি নিরাপদ ছিল?”
“না। অন্তত দশ বারো বছরের মতো লম্বা সময়ের পক্ষে তো নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু তখন তো আমি জানতাম না যে, আমি
একরকম অকেজো হয়ে যাব।”
“সেই হাঁড়িটা এখন কোথায় আছে?”
“ঠিক জানি না। তবে সেই হাঁড়িতে মাটি ভরে আমি তাতে একটা ক্যাকটাস লাগিয়েছিলাম। আমাদের ভিতরের বারান্দায় সেটা রাখা ছিল।”
“এখনো সেখানেই আছে?”
“কী করে বলব? আমি তো হাঁড়িটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এই এখন মনে পড়ল।”
“তুমি সেই হাঁড়িটা কি সম্প্রতি লক্ষ করেছ?”
“না। তবে সেই হাঁড়ির ভিতর থেকে মাইক্রোফিল্ম বের করেও কারো কোনো লাভ হবে না। আমি আমার রিপোর্ট নিজস্ব সাংকেতিক ভাষায় লিখেছি। সেই রহস্য আমি ছাড়া আর কারো পক্ষেই ভেদ করা সম্ভব নয়।”