অর্থাৎ নদী ছেড়ে তারা বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বেঁটে সাহেবের কোনো ভাবান্তর নেই। দানবটিও একমনে লঞ্চ চালিয়ে যাচ্ছে।
ঘণ্টা-দেড়েক পর দানবটি কম্পাস দেখে বোটের মুখ বাঁ দিকে ঘোরাল। আরো আধঘণ্টা পর কমিয়ে দিল গতি। দশ মিনিটের মাথায় কুয়াশা ভেদ করে মস্ত কালো দেয়ালের মতো দেখা দিল একটা জাহাজের শরীর। দানবটা সার্চলাইট নিভিয়ে দিল। তারপর খুব দক্ষতার সঙ্গে জাহাজের গা ঘেঁষে দাঁড় করাল লঞ্চটাকে। কাউকে কিছু বলতে হল না। লঞ্চ দাঁড় করানোর এক মিনিটের মধ্যেই জাহাজের ওপর থেকে একটা মস্ত দড়ি নেমে এল। তার মাথায় আড়াআড়ি একটা লোহার ডাণ্ডা। ডাণ্ডার দুধারে দুটো হুক। দানবটা লঞ্চের মাথায় দাঁড়িয়ে হুক দুটো লঞ্চের ছাদে দুটো আংটায় পরিয়ে দিল। তারপর মসৃণ গতিতে দড়িটা লঞ্চটাকে আরোহী সমেত টেনে তুলে নিল ওপরে।
ডেকের ওপর বেশ কয়েকজন লোক। তাদের চেহারা খুবই স্বাস্থ্যবান। কালো ওভারঅল পরা। কারো মুখে কথা নেই। দুজন তোক একটা স্ট্রেচারে বাঞ্ছারামের অচেতন দেহ বহন করে। নিয়ে জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে খোলের মধ্যে নেমে গেল।
আপাতদৃষ্টিতে জাহাজটা মালবাহী। তবে খোলের মধ্যে একটু জটিল গলিঘুজি পেরিয়ে গেলে চমৎকার কয়েকটি কেবিন আছে। আছে একটি মাঝারি ল্যাবরেটরিও।
বাঞ্ছারামের দেহটি একটি বিশেষ কেবিনে রাখা হল। গম্ভীর মুখে ডাক্তার গোছের একজন লোক এসে বাঞ্ছারামের নাড়ি আর বুক পরীক্ষা করে রক্তচাপ মাপে। সহকারীদের কয়েকটা নির্দেশ দেয়। বাঞ্ছারামের নাকে অক্সিজেনের নল ঢোকানো হয়। গোটা দুই ইনজেকশন দেওয়া হয় পর-পর।
ডাক্তার তার কাজ শেষ করে বেঁটে লোকটার দিকে চেয়ে ইংরিজিতে বলে, “কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।”
বেঁটে লোকটা ঠাণ্ডা গম্ভীর গলায় বলে, “কী ঠিক হবে? জ্ঞান ফিরে আসবে? সে তো বাচ্চা ছেলেও বলতে পারে। ওর
স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কী করতে পারো?”
ডাক্তার মাথা নেড়ে বলে, “এখন কিছুই করা যাবে না। ওর বিশ্রাম দরকার।”
“কতক্ষণ?”
“অন্তত দশবারো ঘন্টা।”
“তারপর কী করবে?”
“তারপর একটা টুথ ইনজেকশন দেব। সেই ইনজেকশনের পর আধ ঘন্টার মধ্যেই তুমি ওর কাছ থেকে সত্যি কথাটা জেনে নিতে পারবে।”
“ওর একটু মাথা খারাপ আছে। স্মৃতিশক্তিও বোধহয় ঠিক নেই। এই অবস্থায় টুথ ইনজেকশনে কি কোনো কাজ হবে?”
“দেখা যাক।”
“ইলেকট্রিক শক দিলে কেমন হয়?” ডাক্তার একটু হাসে। মাথা নেড়ে বলে, “তুমি বড় বেশি তাড়াহুড়ো করছ। যদি ভাল ফল চাও তবে তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। লোকটার বয়স হয়েছে। বেশি ধকল সহ্য করতে পারবে না। মরে যেতে পারে।”
বেঁটে লোকটা ঠাণ্ডা গলায় বলে, “মরলে আমাদের ক্ষতি নেই। শুধু মরার আগে আমরা কিছু তথ্য বের করে নিতে চাই।”
ডাক্তার ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “ঠিক আছে। আমি যথাসাধ্য করব। তবে মনে রেখো তুমি একটু বেশি ঝুঁকি নিচ্ছ।”
বেঁটে লোকটা নিরুত্তাপ গলায় বলে, “শেষ অবধি তো ওকে মেরে ফেলতেই হবে।”
ডাক্তার আর কিছু বলল না।
বেলা দশটা নাগাদ বাঞ্ছারাম চোখ মেললেন। তাঁর সর্বাঙ্গে ব্যথা। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চারদিকে চেয়ে কিছু চিনতে পারলেন না। শুধু অস্ফুট গলায় বললেন, “দিদি, রসগোল্লা খাব।”
সাদা পোশাক পরা একজন লোক এগিয়ে এল সিরিঞ্জ হাতে। বাঞ্ছারাম ভয় পেয়ে হাত গুটিয়ে নিতে গেলেন। পারলেন না। হাত-পা সব স্ট্র্যাপ দিয়ে খাটের সঙ্গে বাঁধা। ইনজেকশনটায় বেশ ব্যথা পেলেন বাঞ্ছারাম। “উঃ” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। চোখে জল এসে গেল। নাকের মধ্যে একটা নল পরানো। ঝাঁঝালো অক্সিজেন বুকের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। নাক জ্বালা করছে। বাঞ্ছারাম ছটফট করতে লাগলেন। হাত-পায়ের বাঁধন খোলার জন্য টানাহ্যাঁচড়া করতে লাগলেন।
হঠাৎ সামনে দেখেন, সেই দানবটা দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে হাত, দু চোখে নিষ্ঠুর হিংস্র চাউনি। বাঞ্ছারাম ভয়ে আর নড়লেন না। লোকটা হিন্দিতে বলল, “বেশি নড়াচড়া কোরো না। তোমার হাত-পা শক্ত করে বাঁধা আছে। নড়লে জখম হবে। তাছাড়া পরশুর মারের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি।”
“আমি কোথায়?”
“ভাল জায়গায় আছ। একটা জাহাজে। মাঝ-দরিয়ায়। চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ শুনতে পাবে না। অতএব চুপ করে লক্ষ্মীছেলের মতো শুয়ে থাকো।”
বাঞ্ছারাম শুয়ে রইলেন। বোজা চোখের কোল ভরে উঠল চোখের জলে। একটু ফুঁপিয়ে উঠলেন।
বিকেল না সকাল, আলো না অন্ধকার তা বোঝবার উপায় নেই। কেবিনের জানালা বন্ধ, দরজা বন্ধ। ঘরে সারাক্ষণ একটা মৃদু বাতি জ্বলছে। বাঞ্ছারাম কয়েকবার ঘুমিয়ে পড়লেন। আবার জাগলেন। আবার ঘুমোলেন।
বহুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর বেঁটে লোকটাকে হঠাৎ দেখতে পেলেন বিছানার পাশে। সঙ্গে ডাক্তার।
বেঁটে লোকটা তেমনি শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেমন বোধ করছ?”
বাঞ্ছারাম হাঁ করে চেয়ে রইলেন। মুখে কথা এল না।
বেঁটে লোকটার কথায় ধমক-চমক নেই, কিন্তু এমন একটা ৫৮
ঠাণ্ডা নিষ্ঠুরতা আছে যা হৃৎপিণ্ডকে থামিয়ে দিতে চায়। অথচ লোকটা পুতুলের মতো ছোটখাটো। যে-কেউ ওকে এক হাতে মাটি থেকে তুলে নিতে পারে। কিন্তু ওর চোখের দিকে চাইলে বা ওর ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বরটি শুনলে কারোরই আর ওকে ঘাঁটাতে সাহস হবে
। লোকটা বাঞ্ছারামের দিকে অনেকক্ষণ পলকহীন চোখে চেয়ে থেকে বলল, “কিছু মনে কোরো না, পৃথিবীর স্বার্থে তোমাকে কিছু কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে। আমরা তোমার ওপর কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করব। তাতে তোমার মৃত্যু অবধি ঘটতে পারে। কিন্তু আমাদের অন্য উপায়ও নেই।”