ককিয়ে উঠল রতন। একটা জ্যাব যে কী সাংঘাতিক জোরালো হতে পারে তা তার এতকাল ধারণা ছিল না। পাঁজরে লাগার সঙ্গে সঙ্গে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তবু রতন তো
বক্সার। বহু মার খেয়েছে। এক লাফে অনেকটা পিছিয়ে গেল সে। পায়ের কাজে রোলোর বাড়ানো ঘুষিগুলোর কয়েকটা এড়িয়েও গেল। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল, রোলো তার চেয়ে বা সুব্বার চেয়ে বা ভারতের সেরা যে কোনো বক্সারের চেয়েও অনেক বেশি দক্ষ মুষ্টিযোদ্ধা।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড রতন নিজেকে বাঁচাতে পারল। তারপরই নানা দিক থেকে বিষাক্ত সাপের ছোবলের মতো রোলোর ঘুষি এসে পড়তে লাগল।
রতনের কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে। ঠোঁটে ঢুকে গেছে দাঁত। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তবু সেও বারবার তার প্রতিপক্ষের মুখে মাথায় তার ঘুষি জমিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু রোলোর রাক্ষুসে ঘুষির তুলনায় তার ঘুষি নিতান্তই দুর্বল। শুধু রোলোর বাঁ ভূর ওপর একটা জায়গা একটু কেটে সামান্য রক্তপাত হচ্ছে। সেও হচ্ছে হাতে গ্লাভস না থাকার দরুন। তা ছাড়া রোলোর আর কিছুই হয়নি।
রতন ক্রমে-ক্রমে পিছু হটছে। সরে যাচ্ছে ঘরের কোণের দিকে। আসলে সরছে না। রোলোই তাকে কুট কৌশলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে রতন পালাতে পারবে না। উপর্যুপরি ঘুষি এসে পড়ছে তার মাথায় মুখে চোয়ালে। এক একবার সে কনুই বা বগলে চেপে ধরেছে বটে রোলোর হাত। কিন্তু পরমুহূর্তেই রোলো ছাড়িয়ে নিচ্ছে নিজেকে। সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক হল রোলোর ডাবল অ্যাকশন পাঞ্চ। একই সঙ্গে ঘুষি এবং কবজির মার।
শেষ পর্যন্ত লড়াই কোথায় গড়াত কে জানে। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ স্বর ডাকল–”রোলো! স্টপ!”
রোলো থামল। ক্রুর চোখে রতনের দিকে একবার চেয়ে
আস্তে-আস্তে পিছিয়ে গেল। দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে বাঁ ভূর ওপরে কাটা জায়গাটায় চেপে ধরল।
রতন হাঁফাচ্ছিল। জীবনে কখনো সে কারো কাছে এক নাগাড়ে এত মার খায়নি। এরকম শক্ত প্রতিপক্ষের সঙ্গে অবশ্য পাল্লাও দিতে হয়নি তাকে। কিন্তু সে আজ বুঝতে পারল, বক্সিং-এর এখনো অনেক কিছুই তার অজানা।
জন উঠে দাঁড়িয়েছে। ডান চোয়ালটা এখনো লাল। মাথাটা ঝাঁকিয়ে সে একটু হাসল। তারপর রতনের দিকে চেয়ে বলল, “কনগ্রাচুলেশনস, রতন। আমি আজ পর্যন্ত রোলোর সঙ্গে এতক্ষণ কাউকে লড়াই চালিয়ে যেতে দেখিনি।”
রতন বেসিনে উপুড় হয়ে মুখে জলের ঝাঁপটা দিল কিছুক্ষণ। দম ফিরে পেয়ে সে বলল, “রোলো খুব ভাল বক্সার। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না যে, তোমরা ভাল লোক।”
জন একটা টেবিলের ওপর উঠে বসে বলল, “আমরা তা প্রমাণ করতে ব্যস্ত নই। কারণ হয়তো আমরা তেমন ভাল লোক নইও। আইনের চোখে অন্তত নয়। তবে আমাদের উদ্দেশ্য খারাপ নাও হতে পারে।”
“কী করে বুঝব?” রতন ফুঁসে উঠে বলে।
জন হাত তুলে তাকে শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত করে মৃদু স্বরে বলে, “তোমার বাবাকে আমরা চুরি করিনি। এটা বিশ্বাস করো। তাঁকে চুরি করে আমাদের লাভ হত না। ডাকাত আর বিপ্লবীদের মধ্যে একটু তফাত আছে।”
“কারা ডাকাত?” রতন জিজ্ঞেস করে। “যারা তোমার বাবাকে চুরি করেছে। কিন্তু তার আগে ঘটনাটা আমাকে বলো। আমাকে বুঝতে দাও কী হয়েছে। শুধু গায়ের জোরে সব সমস্যার সমাধান করতে যেও না।”
লজ্জিত হয়ে রতন একটু হাসল।
৪. কুয়াশার ভিতর দিয়ে
কুয়াশার ভিতর দিয়ে ভোর রাতে একটা স্পীডবোট চলেছে। বাসন্তী পেরিয়ে বাঁ ধারের নদীর ভিতরে ঢুকে গেল স্পীডবোট। মারাত্মক তার গতি। পিছনে সমুদ্রের মতো ঢেউ তুলে জলকে উথালপাথাল করে প্রায় চল্লিশ মাইল বেগে ধেয়ে যাচ্ছে ফাঁইবার গ্লাসের তৈরি অদ্ভূত জলযানটি। হুইল ধরে বসে আছে দানবাকৃতি একটি লোক। শক্তিশালী সার্চলাইটের আলোয় সামনেটা উদ্ভাসিত।
ড্রাইভারের কেবিনের পিছনে ছোট্ট একটা কুঠুরি। এক ধারে স্পঞ্জ রবারের বিছানায় বাঞ্ছারাম অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। পাশে একটি হেলানো চেয়ারে বসে বেঁটে লোকটা কিছু কাগজপত্র দেখছে। এইসব কাগজ বাঞ্ছারামের ল্যাবরেটরি থেকে চুরি করে আনা। কিন্তু কাগজপত্রে কিছু নেই। লোকটা ভ্রু কুঁচকে বিরক্তিতে মাথা নাড়ল। তারপর ঘৃণাভরে একবার তাকাল বাঞ্ছারামের দিকে।
আচমকাই লঞ্চের গতি কমে গেল। গর্জনশীল ইঞ্জিন মৃদু পুটপুট শব্দ করছে। হুইল থেকে মুখ ফিরিয়ে দানব বলল, “জলপুলিশ। আমাদের থামতে বলছে। কী করব?”
বেঁটে লোকটা ভ্রূ কুঁচকেই ছিল। বিরক্তির গলায় বলল, “স্পীড কমিয়ে দাও। দ্যাখো ওরা কী চাইছে।”
“যদি সার্চ করতে চায়?”
“সার্চ করতে দেবে। আগে লাইসেন্স দেখাও। বলো যে, একজন বিদেশী সাংবাদিককে সুন্দরবন দেখাতে এনেছ। আর তোমার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট অসুস্থ হয়ে কেবিনে শুয়ে আছে।”
“ঠিক আছে।”
বেঁটে লোকটা আবার কাগজপত্র দেখতে লাগল। কেবিনে মৃদু আলো জ্বলছে। বোটটার গতি আরো মন্থর হয়ে গেল। দানবটা তার ডানপাশের জানালা খুলে জলপুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। হিন্দি ভাষা সাহেব বোঝে না, তাই গা করল না। জীবনে এর চেয়ে অনেক বড় বড় বিপদের কাজ সে করেছে। বিপদের মধ্যেই তার বাস।
পুলিশ অবশ্য বোটে উঠল না। ফাঁইবার গ্লাসের জলযন্ত্রটি আবার রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল। চারধারে নিবিড় জঙ্গল। ঘন কুয়াশার ভিতর দিয়ে ভোর-ভোর ভুতুরে আলোয় এক অপার্থিব দৃশ্য বলে মনে হয়। ক্রমে নদী চওড়া হতে লাগল। হতে হতে তার কূলকিনারা দেখা গেল না আর। সেই সঙ্গে মস্ত মস্ত ঢেউ এসে দোল দিতে লাগল স্পীডবোটটিকে।