জগতের লোভ লালসা নিষ্ঠুরতার হাত থেকে নিজের অসহায় বাবাকে বাঁচানোর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না রতন। রাতে সে ভাল করে খেল না। ঘুমোতে পারল না।
মাঝরাতে উঠে তার বাবা মাঝে-মাঝে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে বসতেন। এটা তাঁর নেশার মতো ছিল।
গভীর রাতে রতনও বিছানা ছেড়ে উঠল। একটা আলোয়ান জড়িয়ে ধীরে-ধীরে গিয়ে ল্যাবরেটরির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। আলো জ্বেলে বাবার চেয়ারটায় চুপচাপ বসে রইল অনেকক্ষণ। মাথায় কোনো বুদ্ধি আসছে না। বাবার জন্য দুশ্চিন্তায় মাথা পাগল-পাগল লাগছে।
বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি এসেছিল বোধহয়, হঠাৎ শিরশিরে ঠাণ্ডা একটা বাতাস তার ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিতেই সে চোখ মেলল। বক্সিং করে বলেই তার স্নায়ু সতেজ ও সজাগ। সমস্ত শরীরটা চোখের পলকে চিতাবাঘের মতো তৈরি হয়ে গেল।
এক লাফে রতন দরজার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে লাগল।
কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছুবার আগেই দরজাটা আস্তে খুলে গেল। রতন অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায়। চৌকাঠে হাসিমুখে জন দাঁড়িয়ে।
“তুমি!” তেতো গলায় রতন বলে।
জন মাথা নেড়ে বলল, “আমিই। এ ফ্রেন্ড। তুমি কি ভয় পেয়েছ?”
রতনের মাথার মধ্যে নানারকম কথা আসছে। জন যে সাদাসিধে লোক নয় তা সে খড়ঙ্গপুরেই টের পেয়েছিল। এখানে তার মাঝরাতে হঠাৎ আগমনও নিশ্চয়ই সাধু উদ্দেশ্যে নয়। রতন। চাপা স্বরে বলল, “কেন এসেছ? কী চাও?”
জন হাসিমুখেই বলে, “উত্তেজিত হোয়ো না। সত্যি বটে যে, আমি অনেকটা চোরের মতোই এসেছি। তুমি যে এখানে থাকবে, তা আমার জানা ছিল না।”
রতন রাগে ফুঁসছে। ঘন-ঘন শ্বাস ছাড়ছে। কে বা কারা তার বাবাকে নিয়ে গেছে, তা সে জানে না। কিন্তু ঘটনাটায় জনের হাত থাকতেই পারে। জন ছাড়া তার বাবার ব্যাপারে কাউকেই সে আগ্রহী হতে দেখেনি। দাঁতে দাঁত পিষে সে বলল, “আমার বাবাকে কারা চুরি করে নিয়ে গেছে তা তুমি জানো?”
জন সত্যিকারের অবাক হয়। তার সাদা মুখ আরো সাদা হয়ে যায় হঠাৎ। অপলক চোখে সে কিছুক্ষণ রতনের দিকে চেয়ে থেকে বলে, “তোমার বাবাকে চুরি করেছে? কী আশ্চর্য ব্যাপার!”
কিন্তু জনের কথাবার্তায় প্রতিক্রিয়ায় একটু উঁচুদরের অভিনয় রয়েছে বলে মনে হয় রতনের। তার অসহায় বুড়ো পাগল বাবাকে নিতান্ত ব্যবসায়িক কারণে চুরি করে নিয়ে গিয়ে এরা না জানি কত কষ্ট দিচ্ছে। রতনের মাথার ঠিক ছিল না। হঠাৎ সে ফিসফিস করে বলল, “ন্যাকামি কোরো না জন। তুমি খুব ভালই জানো।”
জন একটা হাত বাড়িয়ে রতনের কাঁধ ধরে বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না জানি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য খারাপ কিছু নয়।”
“খারাপ নয়? তবে এত রাতে চুরি করে আমার বাবার ল্যাবরেটরিতে ঢোকার মানে কী?”
জন একথার জবাব দিতে পারল না। শুধু মাথা নেড়ে বলল, “আমি দুঃখিত, তোমরা ভারতীয়রা বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ। যুক্তি দিয়ে বিচার করলে বুঝতে পারতে আমি চোর নই।”
“আলবাত চোর। বাবার গবেষণা হাত করার জন্য আমার বাবাকে তুমি চুরি করেছ।”
জন একটা ধমক দিল। “শাট আপ রতন।”
এইটুকু প্ররোচনারই প্রয়োজন ছিল। শুকনো বারুদে আগুন লাগলে যেমন হয় তেমনি একটা রাগ জ্বলে উঠল রতনের ভিতরে। গায়ের আলোয়ানটা এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে সে বাঁ হাতে বিষাক্ত একটা ঘুষি মারল জনের মুখে। সেই ঘুষি সহ করার মতো বেশি মানুষ নেই। জন “ওফ” শব্দ করে ছিটকে পড়ল দরজার পাল্লায়। তারপর গড়িয়ে পড়ল মেঝেয়।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরের অন্ধকার বারান্দা থেকে দরজার চৌকাঠে উদয় হল রোলো। এক পলক সে জনের নিথর শরীরটার দিকে চেয়ে রইল, তারপর মুখ তুলে তাকাল রতনের দিকে। দুটো চোখ ধকধক করছে হিংস্রতায়।
কিন্তু রোলো তাড়াহুড়ো করল না। ধীর পায়ে জনকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকল, তারপর নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ঘুরে রতনের মুখোমুখি হল সে। মুখে কথা নেই। কিন্তু তার দুই মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখেই বোঝা যায় সে কী চাইছে।
রতনও তাই চায়। বাবার জন্য তার দুঃখ এবং আক্রোশ তাকে পাগল করে তুলেছে। সে চায় প্রতিশোধ। হিংস্র চোখে সেও
রোলোর চোখে চাইল। মুখোমুখি রক্তলোলুপ দুই বাঘ। ৫০
একটা কি দুটো সেকেন্ড পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল তারা। তারপরই পিছল সাপের মতো রোলো এগিয়ে আসে। দুর্বোধ একটা শব্দ করে মুখে। তার বাঁ হাত এত দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসে যে, রতন হাতটা ভাল করে দেখতেই পায় না। সুব্বাও এত দ্রুত ঘুষি মারতে পারে না নিশ্চয়ই। কিন্তু রতনের রিফ্লেক্স খুব ভাল কাজ করছে আজ। সে চকিতে তার মাথা সরিয়ে নেয়। এক কদম সরে যায় ডাইনে। তারপর একটা ক্রস চালায় রোলোর কানের পাশে। আশ্চর্য! রোলো রতনের দিকেই চোখ রেখেছিল। ইচ্ছে করলে ঘুষিটা এড়াতেও পারত, কিন্তু সে চেষ্টা করল না। কিন্তু রতন টের পেল তার ঘুষিটা যেন একটা শক্ত পাথরের দেয়ালে গিয়ে লাগল। কবজি চিনচিন করে উঠল ব্যথায়। যে ঘুষিতে ভারতের যে কোনো প্রথম শ্রেণীর মুষ্টিযোদ্ধার পড়ে যাওয়া উচিত, তা অনায়াসে হজম করে রোলো ফিরে দাঁড়াল।
রতন দেখল রোলোর গার্ড নেই। এই সুযোগ। সে চকিত পায়ে নিজেকে গুছিয়ে অ্যাটাকিং পোজিশনে সরে এসে ডান পা বাড়িয়ে দুর্দান্ত একটা সোজা ঘুষি চালাল রোলোর মাথায়। রতনের কনুই শরীরে লাগানো ছিল ঘুষি মারবার সময়। শরীরের ওজনটাকে সে ঘুষিতে সঞ্চার করতে পেরেছে। লাগলে বোমার মতো কাজ হত। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রোলো সীল মাছের মতো একটা গোঁত খেয়ে নিচু হয়ে ঘুষিটা ভাসিয়ে দিল মাথার ওপর। আর সেই নিচু কুঁজো অবস্থা থেকেই ছোট্ট একটা জ্যাব করল রতনের পাঁজরে।