প্রায় আধঘণ্টা পরিচর্যার পর মোটামুটি যখন কথা বলার মতো অবস্থা হল দু’জনের, তখন ভূতনাথ নন্দী শুধু বললেন, “স্ট্রেঞ্জ থিং।”
সমাজ মিত্তির গুছিয়ে বসে বললেন, “বেশ খোলসা করে বলো তো ভায়া, বেশ বিস্তারিত বলো।”
ভূতনাথ নন্দী মাথা নেড়ে বললেন, “বিস্তারিত বলার কিছু নেই। দুপুর সোয়া তিনটে নাগাদ আমি আর হরুয়া বাড়িতে ঢুকেছি। ঢুকে দেখি দরজার তালা ভাঙা। অবাক হওয়ার ব্যাপার নয়, নির্জন জায়গায় বাড়ি, চোর হানা দিতেই পারে। তাই আমি বাড়িটাতে দামি জিনিস কিছুই রাখি না। সামান্য দুটো খাট, বিছানা, আর দু-চারটে পুরনো অ্যালুমিনিয়ামের বাসনকোসন। যায় যাক। তাই তালা ভাঙা দেখে আমরা চেঁচামেচি, থানা-পুলিশ করিনি। হরুয়া একটু তড়পাচ্ছিল বটে, তবে সেটা ফাঁকা আওয়াজ। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখলুম, চোর কিছুই নেয়নি, কিন্তু দু-দুটো ঘরের মেঝেয় বিরাট করে গর্ত খুঁড়েছে। ওই উত্তরপাশের ঘরটায় আর পেছনের ঘরটায়। দুটো গর্তই সদ্য খোঁড়া। বাড়ির মেঝে এরকম জখম হওয়ায় হরুয়া তো খুব রেগে গেল, লাঠি হাতে চারদিকটা ঘুরে দেখেও এল। আমি রেগে গেলেও জানি, পুরনো বাড়িতে গুপ্তধন থাকতে পারে এই ধারণায় অনেকে খোঁড়াখুঁড়ি করে।”
সমাজ মিত্তির গম্ভীর মুখে শুনছিলেন। বললেন, “গর্ত দুটো একটু দেখে আসতে পারি?”
“বাধা কী? যান, দেখে আসুন। ওরে হরুয়া, বাতিটা দেখা তো।”
সমাজ দ্বিজপদ আর বটকেষ্টকে নিয়ে গর্ত দেখলেন। দুটো গর্তই কোমরসমান হবে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ করেই গর্ত খোঁড়া হয়েছে।
সমাজ মিত্তির ফিরে এসে বললেন, “তারপর বলো ভায়া।”
“আমি বিকেলের দিকটায় জিনিসপত্র গোছগাছ করছি। হরুয়া গেছে উঠোনের জঙ্গল কাটতে। এমন সময় হঠাৎ একটা বেশ
লম্বাচওড়া লোক ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, “এটা অঘোর সেনের বাড়ি না? লোকটা হঠাৎ বিনা নোটিশে হুট করে ঢুকে পড়ায় আমি বিরক্ত হয়েছিলুম। বেশ ধমক দিয়ে বললুম, ‘না মশাই, এটা অঘোর সেনের বাড়ি নয়। আপনি আসুন।’ লোকটা একথায় রেগে গিয়ে বলল, এটাই অঘোর সেনের বাড়ি। তুই এখানে কী করছিস? আমি রেগে গেলেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললুম, এ-বাড়ি কার, তা আমি জানি না। তবে আমি বক্সির কাছে কিনেছি।”
“তারপর কী হল?”
“ব্যস, কথা ওটুকুই। বাকিটা অ্যাকশন। লোকটা হঠাৎ মুগুরের মতো একটা জিনিস বের করে ধাঁই করে মাথায় মারল। আর কিছু জানি না।”
হরুয়া বলল, “আমি লোকটাকে দেখিনি। আপনমনে জঙ্গল সাফা করছিলাম, হঠাৎ কে যে কোথা থেকে কী দিয়ে মারল তা ভগবান জানেন।”
সমাজ মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাদের কপালে বোধ হয় আরও কষ্ট আছে, ভূতনাথ। তোমরা বরং এখানে এখন আর থেকো না।”
“কেন বলুন তো?”
“অঘোর সেনের খোঁজ যখন শুরু হয়েছে, তখন সহজে শেষ হবে না।”
“অঘোর সেনটা কে?” “সে বৃত্তান্ত পরে শুনো। আজ বিশ্রাম নাও। গাঁ থেকে কয়েকজন শক্তসমর্থ লোক পাঠাচ্ছি। তারা আজ বাড়িটা পাহারা দেবে।”
৩. মামা আর ভাগ্নে পাশাপাশি
গভীর রাত্রি। মামা আর ভাগ্নে পাশাপাশি দুটো চৌকিতে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। দু দিন খুব খাটাখাটনি গেছে। শরীর দু’জনেরই খুব ক্লান্ত। পাড়াটা শান্ত, চুপচাপ। মাঝে-মাঝে রাতচরা পাখির ডাক, ঝিঁঝির শব্দ, কখনও কুকুরের একটু ঘেউ-ঘেউ। তাতে ঘুমটা আরও গভীরই হয়েছে দু’জনের।
রাত যখন প্রায় একটা, তখন সুবুদ্ধি হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসল। তার মনে হল, কে যেন করুণ স্বরে কাকে ডাকছে। বারবার ডাকছে, অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে।
“কার্তিক! ওরে কার্তিক?”
আধো-ঘুমের মধ্যেই কার্তিক বলল, “কী মামা?”
“কে কাকে ডাকছে বল তো! কারও বিপদ-আপদ হল নাকি?”
“হলেই বা! তুমি ঘুমাও।”
“ওরে না। পাঁচজনের বিপদে-আপদে দেখতে হয়। পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে বাস করতে গেলে অমন মুখ ঘুরিয়ে থাকলে হয় না।”
কার্তিক উঠে বসল। হাই তুলে বলল, “কোথায়, আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না!”
“কান পেতে শোন।”
কার্তিক কানখাড়া করল। কিছুক্ষণ পর বলল, “কোথায় কী? তুমি স্বপ্ন দেখেছ।”
সুবুদ্ধিও শব্দটা আর শুনতে পাচ্ছিল না। বলল, “স্বপ্ন দেখা যায়। স্বপ্ন কি শোনা যায় রে? আমি শব্দটা শুনেছি।“
“রাত্রিবেলা কতরকম শব্দ হয়। ঘুমোও তো।”
“উঁহু, ভুল শুনেছি বলে মনে হয় না। মিলিটারিতে ছিলাম, আমাদের অনেক কিছু শিখতে হয়েছে।”
কার্তিক শুয়ে চোখ বুজল, আর সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। সুবুদ্ধিও শুল। তবে তার মনটা খচখচ করছিল। একটু এপাশ-ওপাশ করে সেও শেষ অবধি ঘুমোল।
রাত দুটো নাগাদ হঠাৎ কার্তিক ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, “মামা, ও মামা! শব্দটা শুনেছ?”
সুবুদ্ধি ঘুম ভেঙে বলল, “কিসের শব্দ?”
“তোমার শব্দটাই গো! কে কাকে ডাকছে। শোনোনি?”
সুবুদ্ধি টর্চটা নিয়ে মশারি তুলে বেরিয়ে এল, “চল তো দেখি।”
“ও মামা, এবাড়িতে ভূত নেই তো!”
“দুর! ভূত থাকলে বাড়িটা এত শস্তা হত নাকি? ভূতের দাম শুনলি না?”
“তাই তো!”
“কী নাম ধরে ডাকছিল বুঝতে পারলি?”
“কার্তিক মাথা নেড়ে বলল, “না। খুব অস্পষ্ট শব্দ। তবে মনে হল কী বাবু বলে যেন ডাকছিল।”
“আমিও ওরকমই শুনেছি। ঘোষবাবু না বোসবাবু কী যেন।”
“মামা, আমার বড় ভয়-ভয় করছে।”
সুবুদ্ধি একটু হাসল, “ভয়টা কিসের? মানুষ বিপদে পড়ে মানুষকে ডাকে।”