দ্বিজপদ একটু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু অনেক ডাকাডাকিতেও তিনি সাড়া দিলেন না জ্যাঠামশাই?”
সমাজ মিত্তির টপ করে উঠে পড়লেন। বললেন, “তোমরা বোসো, আমি চট করে টর্চ আর লাঠিগাছ নিয়ে আসছি। ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না। একটু সরেজমিনে দেখতে হচ্ছে।”
দ্বিজপদ তাড়াতাড়ি বলল, “লোকজন না নিয়ে কি সেখানে যাওয়া ঠিক হবে জ্যাঠামশাই? আমি বরং তোক ডাকতে যাই।”
বটকেষ্ট বলল, “আমার একাদশী পিসির বড্ড অসুখ, এখন-তখন অবস্থা। একবার তাঁর বাড়িতে না গেলেই নয়।”
সমাজ মিত্তির দ্বিজপদর দিকে চেয়ে বললেন, “গাঁয়ের লোক আজ প্রায় সবাই মেলায় গেছে, ডেকেও কাউকে বিশেষ পাবে
। আর ডেকে হবেটাই বা কী? তারাও তো তোমাদের মতোই ভিতুর ডিম।”
তারপর বটকেষ্টর দিকে চেয়ে বললেন, “একাদশীর জন্য চিন্তার কিছু নেই। বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে আজ ন’পাড়ার দিকেই গিয়েছিলুম। দেখলুম একাদশী মস্ত যাঁতায় ডাল ভাঙছে।”
দুজনেই একটু অপ্রস্তুত। সমাজ মিত্তির তাঁর মোটা বাঁশের লাঠি আর টর্চ নিয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, “চলো। দেরি করা ঠিক হবে না।”
সমাজ মিত্তির আগে-আগে টর্চ ফেলতে ফেলতে আর লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে, দ্বিজপদ আর বটকেষ্ট একটু পেছনে জড়সড় আর গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে এগোতে লাগল।
বাঁশবনে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। জোনাকি জ্বলছে বলে অন্ধকারটা যেন আরও ঘন মনে হচ্ছে। মানুষের সাড়া পেয়ে দু-চারটে বন্যপ্রাণী, শেয়াল আর মেঠো ইঁদুরই হবে, দৌড়ে পালাল। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই।
বাঁশবন পেরিয়ে বাড়ির চাতালে পৌঁছে মিত্তিরমশাই চারদিকে টর্চ ফেললেন। বাড়িতে কোনও আলো জ্বলছে না। তবে সদর দরজাটার একটা পাল্লা হাঁ করে খোলা।
সমাজ মিত্তির হাঁক মারলেন, “ভূতনাথ! ভূতনাথ আছ নাকি?”
নির্জন ফাঁকা অন্ধকারে ডাকটা এমন বিটকেল শোনাল যে, দু’জনের পিলে চমকে গেল। সমাজ মিত্তিরের গলায় যে এত জোর, তা তাদের জানা ছিল না। যে ডাকে মড়া পর্যন্ত উঠে বসে, সেই ডাকেও ভূতনাথের সাড়া পাওয়া গেল না।
সমাজ মিত্তির দুশ্চিন্তার গলায় বললেন, “নন্দীর পোর হল কী?”
দ্বিজপদ ভাঙা গলায় বলল, “বোধ হয় টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ডিস্টার্ব করাটা ঠিক হবে না জ্যাঠামশাই।”
বটকেষ্ট বলল, “ভূতনাথ নন্দীর বদলে আর কাউকে দেখেননি তো জ্যাঠামশাই? বয়স হলে তো একটু-আধটু ভুল হতেই পারে।”
সমাজ মিত্তির অবশ্য কোনও কথাই কানে তুললেন না। লাঠিটা বাগিয়ে ধরে এগোতে এগোতে বললেন, “একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছি হে। এসো দেখা যাক।”
দ্বিজপদ বলে উঠল, “কাজটা কি ঠিক হচ্ছে জ্যাঠামশাই? ট্রেসপাসিং হচ্ছে না?”
বটকেষ্ট বলে উঠল, “কথাটা আমারও মনে হয়েছে। ট্রেসপাসিংটা মোটেই ভাল জিনিস নয়।”
বাড়ির বারান্দায় উঠে সমাজ মিত্তির আবার বাঘা গলায় ডাকলেন, “ভূতনাথ, আছ নাকি? ভূতনাথ?”
সেই ডাকে দুটো বাদুড় উড়ল। কয়েকটা চামচিকে চক্কর মারতে লাগল। দূরে কোথাও কুকুর ডেকে উঠল ভৌ-ভৌ করে। কিন্তু ভূতনাথ সাড়া দিলেন না।
অবশ্য সাড়া দেওয়ার মতো অবস্থাও তাঁর ছিল না। বাইরের ঘরের মেঝের ওপর তিনি পড়ে ছিলেন উপুড় হয়ে। মাথার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ে মেঝে ভেসে যাচ্ছিল।
দৃশ্যটা টর্চের আলোয় দেখে সমাজ মিত্তির বললেন, “সর্বনাশ! এ তো দেখছি খুন করে রেখে গেছে ভূতনাথকে!”
দু’জনে একসঙ্গে বলে উঠল, “খুন!”
সমাজ মিত্তির উত্তেজনা ভালবাসেন, ঘটনা ঘটলে খুশি হন, কিন্তু দৃশ্যটা দেখে তিনি তেমন খুশি হলেন না। হাঁটু গেড়ে বসে ভূতনাথের নাড়ি পরীক্ষা করতে লাগলেন।
দ্বিজপদ বলল, “ডেডবডি নাড়াচাড়া করাটা ঠিক হচ্ছে না জ্যাঠামশাই। পুলিশ ওতে রেগে যায়।”
বটকেষ্ট বলল, “মড়া ছুঁলে আবার চানটান করার ঝামেলা আছে। এই বয়সে কি ওসব সইবে আপনার?”
সমাজ মিত্তির একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “এখনও মরেনি। প্রাণটা আছে। ওহে, তোমরা একটু জলের জোগাড় করো দেখি। জলের ঝাঁপটা দিয়ে দেখা যাক জ্ঞান ফেরে কি না। তারপর বিছানায় তুলে শোওয়াতে হবে। আর দেখো, বাতিটাতি কিছু আছে কি না।”
জল পাওয়া গেল ভূতনাথের ওয়াটারবলে। চোখে-মুখে ঝাঁপটা দেওয়ার পর বাস্তবিকই ভূতনাথ চোখ খুললেন। তবে চোখের দৃষ্টি ফ্যালফ্যালে। কোনও ভাষা নেই। টেবিলের ওপর মোমবাতি আর দেশলাই ছিল। বাতি জ্বালানোর পর ভূতনাথকে বিছানায় তুলে শোওয়ানো হল। ফার্স্ট এইড বক্সও দেখা গেল ঘরে মজুত আছে। সমাজ মিত্তির ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে নিজের হাতেই ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বললেন, “ওহে, তোমরা হরুয়াকে খুঁজে দেখো। মনে হচ্ছে তার অবস্থাও এর চেয়ে ভাল নয়। টর্চটা নিয়ে যাও।”
বটকেষ্ট আর দ্বিজপদ সিঁটিয়ে গেলেও মুখের ওপর না করতে পারল না। দ্বিজপদর একবার ইচ্ছে হল বলে যে, হয়তো বাজারে-টাজারে গেছে, এসে যাবে। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে বলাটা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হল না তার।
হরুয়াকে পাওয়া গেল ভেতরদিককার উঠোনে। উঠোনে মস্ত আগাছার জঙ্গল। তার মধ্যেই পড়ে ছিল হরুয়া। কপালের বাঁ দিকে বেশ গভীর ক্ষত। তবে হরুয়াও বেঁচে আছে। তার বিশাল চেহারা, ধরাধরি করে তুলে আনা কঠিন ব্যাপার। দ্বিজপদ ওয়াটারবটুল এনে তার মুখে-চোখে ঝাঁপটা দেওয়ার পর হরুয়া চোখ মেলল। প্রথম কিছুক্ষণ তার চোখেও ভ্যাবলা দৃষ্টি। তবে সে পালোয়ান মানুষ। কয়েক মিনিট বাদে ধীরে-ধীরে উঠে বসে বলল, “জয় বজরঙ্গবলি”।