দ্বিজপদ উত্তেজিত হয়ে বলল, “কিন্তু ডাকাতটার ব্যাপারে কী। করা যায়?”
“প্রথম কথা, লোকটা ডাকাত কিনা আমরা জানি না। দ্বিতীয় কথা, খুনিও বলা যাচ্ছে না, কারণ তোকে লোকটা খুন করেনি। তিন নম্বর হল, লোকটাকে এখন ভূতনাথ নন্দীর বাড়িতে পাওয়া যাবেই এমন কথা বলা যাচ্ছে না। বুদ্ধিমান হলে এতক্ষণে তার সরে পড়ার কথা। চার নম্বর হল, লোকটার যেমন বিরাট চেহারা আর গায়ের জোর বলছিস তাতে আমরা দুজন গিয়ে সুবিধে করতে পারব না। লোকলশকর ডেকে নিয়ে যেতে হবে। সেটা
সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। গাঁয়ে আজ লোকজন বিশেষ নেই, কারণ। বেশিরভাগই গেছে চড়কডাঙার মেলায়। ছ নম্বর কথা হল”
“ভুল হচ্ছে। এটা পাঁচ নম্বর হবে।”
“তা পাঁচ নম্বরই সই। পাঁচ নম্বর কথা হচ্ছে, অঘোর সেন সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা গেলে লোকটাকে জেরা করার সুবিধে হবে।”
“তুই একটা কাপুরুষ।”
“তাও বলতে পারিস, তবে কাপুরুষ হলেও আমি বুদ্ধিমান। এখন চল তো।”
বটকেষ্ট দোকান বন্ধ করে দ্বিজপদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
সমাজ মিত্তির পুরনো আমলের লোক সন্দেহ নেই। বয়স এই সাতানব্বই পুরে আটানব্বই চলছে। এখনও বেশ শক্তসমর্থ আছেন। নন্দপুরের কায়স্থপাড়ায় নিজের বারান্দায় বসে সন্ধেবেলায় তিনি গেলাসে গোঁফ ডুবিয়ে দুধ খাচ্ছিলেন। একটু আগেই সায়ংভ্রমণে বেরিয়ে মাইল তিনেক হেঁটে এসেছেন।
বটকেষ্ট আর দ্বিজপদকে দেখে এক গাল হেসে বললেন, “গোঁফ ডুবিয়ে দুধ খেলে দুধের স্বাদ বেড়ে যায়, জানো?”
অন্য সময় হলে দ্বিজপদ গোঁফে বায়ুবাহিত জীবাণুর প্রসঙ্গ তুলত এবং গোঁফ ডুবিয়ে দুধ খাওয়া যে খুব খারাপ অভ্যাস, তাও প্রমাণ করে ছাড়ত। কিন্তু গুণ্ডাটার ঝাঁকুনি খেয়ে আজ তার মাথা তেমন কাজ করছে না, মেজাজটাও বিগড়ে আছে। সে বিরস মুখে বলল, “কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। বলি মিত্তিরজ্যাঠা, আরাম করে তো দুধ খাচ্ছেন, এদিকে যে গাঁয়ে ডাকাত পড়েছে সে-খবর রাখেন?”
সমাজ মিত্তির সটান হয়ে বসে বললেন, “ডাকাত পড়েছে?”
“তবে আর বলছি কী?”
সমাজ মিত্তির ভারী খুশি হয়ে বললেন, “তা কার বাড়িতে পড়ল? কী-কী নিয়ে গেল? খুনখারাপি হয়েছে তো! সব বেশ খোলসা করে বলো দেখি, শুনি। আহা, নন্দপুরে কতকাল ডাকাত পড়েনি! সেই একুশ বছর আগে চৌধুরীদের বাড়িতে পড়েছিল, তারপর সব সুনসান।”
ডাকাতি যে সমাজবিরুদ্ধ ব্যাপার এবং মোটেই ভাল জিনিস নয় তা নিয়ে তর্ক করার জন্য দ্বিজপদর গলা চুলকে উঠল। কিন্তু নিজেকে কষ্টে সামাল দিল সে, আজ তর্কে সে এঁটে উঠবে না।
বটকেষ্ট বলল, “মাঝে-মাঝে ডাকাত পড়া কি দরকার বলে মনে হয় আপনার জ্যাঠামশাই?”
“খুব দরকার হে, খুব দরকার। গাঁয়ের জীবন বড়ই নিস্তরঙ্গ বুঝলে, বড়ই নিস্তরঙ্গ! মাঝে-মাঝে এরকম কিছু একটা হলে গা বেশ গরম হয়। শরীর, মন দুই-ই বেশ চাঙ্গা থাকে। তা বেশ গুছিয়ে বলো তো ঘটনাটা, কিছু বাদসাদ দিও না।”
দ্বিজপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমিই ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিলুম একটু আগে। বিকেলের দিকটায় ভূতনাথবাবুর সন্ধানে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলুম, সেখানেই দেখা। ইয়া সাত ফুট লম্বা আর চওড়া চেহারা, পঞ্চাশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, হাত দুখানা যেন একজোড়া চেঁকি, চোখ ভাঁটার মতো বনবন করে ঘুরছে। আমাকে ধরে এমন ঝাঁকুনি দিচ্ছিল যে, আর একটু হলেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে যেত।“
সমাজ মিত্তির ঝুঁকে বসে আহ্বাদের গলায় বললেন, “তারপর?”
“তারপর কোনওরকমে তার হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে এসেছি। একসময়ে ব্যায়ামট্যায়াম করতুম তো, তাই পারলুম। অন্য লোক হলে দাঁতকপাটি লেগে পড়ে থাকত।”
বটকেষ্ট চাপা গলায় বলল, “লোকটার হাইট এক ফুট বাড়িয়ে দিলি নাকি? চওড়াটাও যেন বেশি মনে হচ্ছে।”
সমাজ মিত্তির বললেন, “বাঃ বাঃ, কিন্তু তারপর কী হল?”
দ্বিজপদ বলল, “তারপর এখন অবধি আর কিছু হয়নি। হচ্ছে কি না তা বলতে পারব না। তবে হবে।”
সমাজ মিত্তির নাক সিঁটকে বললেন, “হোঃ, এটা একটা ঘটনা হল? তোমাকে একটু ঝাঁকুনি দিয়েছে, তাতে কী? একে কোন আক্কেলে ডাকাতি বলে জাহির করছ শুনি? রগরগে কিছু হলে না হয় বোঝা যেত। তা লোকটা সেখানে করছিল কী?”
“অঘোর সেন নামে একজনের বাড়ি খুঁজছিল।”
সমাজ মিত্তির ভারী অবাক হয়ে বললেন, “অঘোর সেন! অঘোর সেনের বাড়ি খুঁজছিল? কেন খুঁজছিল তা বলল?”
“না জ্যাঠামশাই, অঘোর সেন নামে যে এ-গাঁয়ে কেউ নেই, তা বলতে গিয়েই তো বিপদটা হল।”
সমাজ মিত্তির বিরক্ত হয়ে বললেন, “অঘোর সেনের বাড়ি যে এ-গাঁয়ে নয় একথা তোমাকে কে বলল? কিছু জানো না, বোঝে না, সেদিনকার ছোঁকরা, ফস করে বলে ফেললে অঘোর সেনের বাড়ি এ-গাঁয়ে নয়? সবজান্তা হয়েছ, না?”
দ্বিজপদ ভারী থতমত খেয়ে গেল। বটকেষ্ট বলল, “আজ্ঞে, সেকথা জানতেই আপনার কাছে আসা। লোকটা নাকি বেশ জোর দিয়েই বলছিল যে, অঘোর সেনের বাড়ি এই নন্দপুরেই!”
সমাজ মিত্তিরও বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, “আলবাত নন্দপুরে। লোকটা ঠিকই বলেছে।“
দ্বিজপদ আমতা-আমতা করে বলল, “তিনি কে জ্যাঠামশাই?”
“তিনি খুব সাঙ্ঘাতিক লোক ছিলেন। কিন্তু সে-কথা থাক। আগে বলো তো, ঘটনাটা যখন ঘটল তখন ভূতনাথ কী করছিল।”
দ্বিজপদ মাথা নেড়ে বলল, “তিনি তো আসেননি!”
সমাজ মিত্তির বললেন, “আসেনি মানে? বললেই হল আসেনি? বেলা তিনটের সময় পালোয়ান ভৃত্য হরুয়াকে নিয়ে এই পথ দিয়েই ভূতনাথ গেছে। আমি তখন বারান্দায় বসে ছিলুম। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে দু দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে গেল। আসেনি মানে?”