“অ। কিন্তু অঘোর সেনের বাড়ি খুঁজতে আপনি যদি ভূতনাথবাবুর বাড়িতে ঘোরাঘুরি করেন তা হলে তো লাভ নেই। অঘোর সেনের বাড়ি খুঁজতে হলে অঘোর সেনের বাড়িতেই যেতে হবে। তাই বলছিলাম, আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। এই নন্দপুরে অঘোর সেন বলে কেউ থাকেন না। অন্য নন্দপুরে খুঁজে দেখতে পারেন।”
লোকটা হঠাৎ এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দ্বিজপদর জামাটা বুকের কাছে খামচে ধরে একখানা রাম ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এখানেই অঘোর সেনের বাড়ি, বুঝলি?”
ঝাঁকুনির চোটে দ্বিজপদর মাথার ভেতরটা তালগোল পাকিয়ে গেল, ঘাড়টাও উঠল মট করে। সে দু’বার কোঁক-কোঁক শব্দ করে বলে উঠল, “যে আজ্ঞে।”
“বাড়িটা কোথায়?” দ্বিজপদর বাঘের থাবায় ইঁদুরের মতো অবস্থা। বলল, “আজ্ঞে, এখানেই কোথাও হবে।”
লোকটা দ্বিজপদকে আর-একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিতেই সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল।
লোকটা রক্ত-জলকরা চোখে চেয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বলল, “বাড়ি যা।”
পড়ে থেকেই দ্বিজপদ খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “যে আজ্ঞে।” তারপর কোনওরকমে উঠে এক দৌড়ে বাঁশবন পেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল। জায়গাটা ভারী নির্জন, হাঁকডাক করলেও কেউ শুনতে পাবে না। দ্বিজপদ পিছু ফিরে একবার দেখে নিয়ে প্রায় ছুটতে-ছুটতে মোড়ের মাথায় বটকেষ্টর মনোহারি দোকানটায় এসে হাজির হল।
বটকেষ্ট তার বন্ধু মানুষ। ক্রিকেটের ভক্ত। গতকালই বটকেষ্টকে সর্বসমক্ষে ক্রিকেট ভাল না ফুটবল ভাল তাই নিয়ে তর্কে হারিয়ে দিয়েছে। বটকেষ্ট তাই দ্বিজপদকে দেখে গম্ভীর হয়ে বলল, “কী চাই?”
দ্বিজপদ হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, “একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি রে ভাই!”
বিরস মুখে বটকেষ্ট বলল, “সাপের মুখে পড়েছিলি বুঝি? তা পারল না ঠুকে দিতে? কুলাঙ্গার আর কাকে বলে!”
“না রে ভাই, সাপ নয়, খুনে ডাকাত। ভূতনাথ নন্দীর খোঁজে, তাঁর ভুতুড়ে বাড়িটায় গিয়েছিলুম। সেখানেই ঘাপটি মেরে ছিল।
যেতেই কাক করে ধরল। মেরেই ফেলত, কোনওক্রমে হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে এসেছি।”
বটকেষ্ট নিরাশ হয়ে বলল, “অপদার্থ! অপদার্থ! এসব লোকের মুখে চুনকালি দিতে হয়।”
দ্বিজপদ রেগে গিয়ে বলল, “কার মুখে চুনকালি দেওয়ার কথা বলছিস?”
বটকেষ্ট বলল, “তোর মুখে নয় রে, তোর মুখে নয়। ডাকাতটার কথাই বলছি। সে কেমন ডাকাত, যার হাত ফসকে লোকে পালিয়ে যায়?”
দ্বিজপদ অবাক হয়ে বলল, “তার মানে? আমি খুন হলে বুঝি ভাল ছিল?”
বটকেষ্ট তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে একটু মোলায়েম গলায় বলল, “সে-কথা হচ্ছে না। বলছিলাম কি, আগেকার মতো খাঁটি জিনিস আজকাল আর পাওয়াই যায় না। তখনকার ডাকাতরা খাঁটি ঘি-দুধ খেত, আস্ত পাঁঠা, আস্ত কাঁঠাল এক-একবারে উড়িয়ে দিত। ক্ষমতাও ছিল তেমনই, মাছিটিও গলে যেতে পারত না তাদের পাল্লায় পড়লে। আর আজকালকার ডাকাতদের চেহারা দেখেছিস? রোগা-দুবলা, উপোসি চেহারা, না আছে জোর, না আছে রোখ। এই তো গত মাসে বরুণ চাকির বাড়িতে ডাকাতি করতে এসে ডাকাতদের কী হেনস্থা! গাঁয়ের লোক মিলে এমন মার মারলে যে, সব ভঁয়ে গড়াগড়ি দিয়ে হাতেপায়ে ধরতে লাগল।”
দ্বিজপদ বুক ফুলিয়ে বলল, “আমার ডাকাতটা মোটেই তেমন নয়। ছ’ ফুটের ওপরে লম্বা, খাম্বাজ চেহারা। ইয়া চওড়া কাঁধ, মুগুরের মতো হাত, রক্তবর্ণ চোখ।”
একটু উৎসাহিত হয়ে বটকেষ্ট বলল, “বটে! তা তোর সব কেড়েকুড়ে নিল বুঝি?”
দ্বিজপদ মাথা নেড়ে বলল, “সেসব নয়। লোকটা অঘোর সেন নামে কার একটা বাড়ি খুঁজছিল। তা সেই অঘোর সেনকে নিয়েই দু-চারটে কথা হয়েছে কি হয়নি, অমনই তেড়ে এসে এমন ঝাঁকুনি দিতে লাগল যে, প্রাণ যায় আর কি!”
বটকের চোখ দুখানা চকচক করে উঠল, “আহা, এসব তেজস্বী মানুষের অভাবেই না দেশটা ছারখারে যাচ্ছে! এমন লোকের পায়ের ধুলো নিতে হয়।”
তেজস্বিতা আর মারকুট্টা ভাব যে এক নয়, বীরত্ব আর গুণ্ডামিতে যে তফাত আছে, এইটে নিয়ে দ্বিজপদ একটা তর্ক বাধাতে পারত। সুযোগও ছিল। কিন্তু কে জানে কেন, তার তর্কের ইচ্ছেটাই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেছে।
দ্বিজপদ শুধু খাপ্পা হয়ে বলল, “ওরকম একটা জঘন্য, খুনিয়া, গুণ্ডা, তেরিয়া, অভদ্র লোক কিনা তেজস্বী! তার আবার পায়ের ধুলোও নিতে ইচ্ছে করছে তোর?”
বটকেষ্ট হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা কল্কি অবতারও হতে পারে। আমাদের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাতে এসেছে। কিন্তু এই অঘোর সেন লোকটা কে?”
দ্বিজপদ একটু ঠাণ্ডা হয়ে বলল, “সেইটেই তো বলতে গিয়েছিলাম যে, নন্দপুরে অঘোর সেন বলে কেউ নেই। নন্দপুর হলেই যে সেখানে অঘোর সেন থাকবেন, এমন কথাও নেই। তা ছাড়া নন্দপুর নামে অনেক গাঁ আছে, অঘোর সেনও খুঁজলে বিস্তর পাওয়া যাবে। কথার পিঠে কথা আর কি। কিন্তু বেরসিক লোকটা এমন তেড়ে এল!”
বটকেষ্ট একটু চিন্তিত মুখ করে বলল, “অঘোর সেন বলে কেউ এখানে নেই ঠিকই, কিন্তু নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে।”
দ্বিজপদ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই চিনবি কী করে? অঘোর সেন নাকি অনেক আগেই মারা গেছেন।”
বটকেষ্ট চিন্তিত মুখেই বলল, “সেটাই স্বাভাবিক। নামটা যেন আমি কোনও পুঁথিপত্রে পেয়েছি, বা কোনও পুরনো লোকের মুখে শুনেছি। এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। মনে হয়, অঘোর সেন একসময়ে বেশ বিখ্যাত লোক ছিলেন। এব্যাপারে মিত্তিরজ্যাঠা কিছু জানতে পারেন।”