“তা হলে কী হবে?”
“সকালের দিকটায় সাবধান থাকতে হবে। ওরে, সব জিনিসেরই ভাল আর মন্দ দুটো দিক আছে। মাছের যেমন কাঁটা বেছে খেতে হয়, এও তেমনই। গোবিন্দ বিশ্বাসের মুখোনা বেলা বারোটার আগে না দেখলেই হল।”
“সকালবেলায় আমাকে ইস্কুলে যেতে হবে। তোমাকেও বাজারহাট করতে হবে।”
“আমরাও চোখ বুজে বেরোব।”
“পারব?”
“অভ্যাস করলে সব পারা যায়।”
কার্তিক হঠাৎ বলল, “আচ্ছা মামা, পুরনো বাড়িতে তো অনেক। সময় গুপ্তধন থাকে, তাই না?”
“তা থাকে হয়তো।”
“এ-বাড়িতেও যদি থাকে?”
“দুর পাগলা।” বলে সুবুদ্ধি খুব হাসল।
২. নন্দপুরের বিখ্যাত তার্কিক
নন্দপুরের বিখ্যাত তার্কিক হল দ্বিজপদ ভটচায়। হেন বিষয় নেই যা নিয়ে সে তর্ক জুড়ে দিতে না পারে। সকালবেলায় হয়তো অম্বুজবাবুর সঙ্গে ভগবান নিয়ে তর্ক বাধিয়ে প্রমাণ করেই ছাড়ল যে, ভগবান টগবান বলে কিছু নেই। যারা ভগবান মানে তারা গাধা। বিকেলে আবার ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গে তর্কে বসে গিয়ে প্রমাণ করে দিল, ভগবান না থেকেই পারেন না। যারা বলে ভগবান নেই তারা মর্কট। এই তো সেদিন ভূগোল-সার নবীনবাবুকে বাজারের রাস্তায় পাকড়াও করে বলল, “মশাই, আপনি নাকি ক্লাসে শেখাচ্ছেন যে, আকাশের রং নীল?”
নবীনবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তা নীল হলে নীলকে আর কী বলা যাবে?”
দ্বিজপদ চোখ পাকিয়ে বলল, “নীলটা তো ভ্রম। আসলে আকাশ ঘোর কালো।”
নবীনবাবু রেগে গিয়ে বললেন, “কালো বললেই হল?” ব্যস, তুমুল তর্ক বেধে গেল। সে এমন তর্ক, যে নবীনমাস্টারের স্কুল কামাই। দাবাড় বিশু ঘোষকে দাবার চাল নিয়ে তর্কে হারিয়ে দিয়ে এল এই তো সেদিন।
দ্বিজপদর তর্কের এমনই নেশা যে চেনা লোক না পেলে অচেনা লোকের সঙ্গেই এটা-ওটা-সেটা নিয়ে তর্ক বাধিয়ে বসে। তর্কে দ্বিজপদর প্রতিভা দেখে ইদানীং তাকে লোক একটু এড়িয়েই চলে। হরকালীবাবু বাগান পরিষ্কার করছিলেন, দ্বিজপদ গিয়ে তাঁকে বলল, “আচ্ছা, বলুন তো মশাই, কোন আহাম্মকে বলে যে সূর্য পুব দিকে ওঠে, আর পশ্চিমে অস্ত যায়?”
হরকালীবাবু ভয় খেয়ে বললেন, “বলে নাকি? খুব অন্যায় কথা। বলাটা মোটেই উচিত নয়।”
সঙ্গে-সঙ্গে দ্বিপদ কথাটার মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “আহা, বলবে নাই বা কেন, বলুন তো! বললে ভুলটা হচ্ছে কোথায়?”
হরকালীবাবু সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বললেন, “না, ভুল তো হচ্ছে। সত্যিই তো, ভুল কেন হবে?”
তর্কের আশা নেই দেখে দ্বিজপদ কটমট করে হরকালীবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমার সঙ্গে একমত হচ্ছেন কেন?”
হরকালীবাবু সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “না, একমত হওয়াটা মোটেই কাজের কথা নয়।”
নন্দপুরের লোকেরা বেশিরভাগই আজকাল তর্কের ভয়ে দ্বিজপদর সঙ্গে একমত হয়ে যায়। ফলে দ্বিজপদর মনে সুখ নেই। গাঁয়ে নতুন লোকও বিশেষ একটা পাওয়া যায় না। সে শুনেছে কলকাতার বিখ্যাত ভূত-বিশেষজ্ঞ ভূতনাথ নন্দী নন্দপুরে নরেন বক্সির একটা ভুতুড়ে বাড়ি কিনেছেন। মাঝে-মাঝে এসে থাকেন এবং ভূত নিয়ে গবেষণা করেন। শুনে ইস্তক দ্বিজপদ প্রায়ই বাড়িটায় এসে ভূতনাথ নন্দীর নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করে। ভূতনাথকে পেলে তাঁর সঙ্গে ভূত নিয়ে একটা ঘোর তর্ক বাধিয়ে তোলার ইচ্ছে আছে তার।
আজও অভ্যাসবশে বিকেলের দিকে দ্বিজপদ হাঁটতে-হাঁটতে ভূতনাথ নন্দীর নতুন কেনা পুরনো বাড়িটায় হানা দিল। পশ্চিমপাড়ায় খুব নির্জন জায়গায় মস্ত বাঁশঝাড়ের পেছনে ভূতনাথের বাড়ি। ঝুরঝুরে পুরনো। পেছনে একটা মজা পুকুর। দিনের বেলাতেই এলাকাটা যেন ছমছম করে। দুটো মস্ত বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে একটা শুড়িপথ গেছে। সেই পথটাও আগাছায় ভরা। দ্বিজপদ পথটা পেরিয়ে বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে একটু গলা তুলে বলল, “ভূতনাথবাবু আছেন কি? ভূতনাথবাবু!”
সাড়া পাওয়া গেল না। দ্বিজপদ হতাশ হয়ে ফিরতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে বাড়ির দেওয়ালের আড়াল থেকে একটা মুশকোমতো রাগী চেহারার লোক বেরিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল, “কাকে খুঁজছেন?”
খুশি হয়ে দ্বিজপদ বলল, “নমস্কার। আপনি কি ভূতনাথবাবু?”
লোকটা তার দিকে স্থির চোখে চেয়ে বলল, “না। এবাড়িটা কার?”
“কেন, ভূতনাথবাবুর! তিনি নরেন বক্সির কাছ থেকে বাড়িটা কিনেছেন।”
“অ। তা হলে অঘোর সেনের বাড়িটা কোথায়?” দ্বিজপদ একটু অবাক হয়ে বলল, “অঘোর সেন? না মশাই, ও নামে কাউকে চিনি না। অঘোর চক্রবর্তী আছেন একজন। বামুনপাড়ায়। আর অঘোর সামন্ত থাকেন কালীবাড়ির পেছনে। আপনার ভুল হচ্ছে।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “ভুল হচ্ছে না। এ-জায়গাটা যদি নন্দপুর হয়ে থাকে, তা হলে এখানেই অঘোর সেনের বাড়ি।”
সামান্য একটু তর্কের গন্ধ পেয়ে দ্বিজপদ হাসল, “নন্দপুর হলেই সেখানে অঘোর সেন বলে কেউ থাকবে এমন কথা নেই। আর নন্দপুরের কথা বলছেন? সারা পশ্চিমবঙ্গ খুঁজলে না হোক পঁচিশ ত্রিশটা নন্দপুর পাবেন। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হরিয়ানাতেও মেলা নন্দপুর আছে। আপনি কি বলতে চান সব নন্দপুরেই একজন করে অঘোর সেন আছেন? তা বলে আমি বলছি না যে অঘোর সেন বলে কেউ নেই। খুঁজলে হয়তো বেশ কয়েকশো অঘোর সেন পাওয়া যাবে। কিন্তু তা বলে তাঁরা যে নন্দপুরেই থাকবেন এমন কোনও কথা আছে কি?”
লোকটা বড্ডই বেরসিক। তর্কে নামার এমন একটা সুযোগ পেয়েও নামল না। তেমনই মোটা আর গম্ভীর গলায় বলল, “অঘোর সেনকে নয়, আমি তাঁর বাড়িটা খুঁজছি। অঘোর সেন বহুকাল আগেই মারা গেছেন।”