লোকটা মুচকি হেসে বলল, “আমি হচ্ছি বিখ্যাত অপয়া গোবিন্দ বিশ্বাস। সকালের দিকে আমার মুখোনা দেখেছ কি সর্বনাশ! ধরো বাজারে বেরোবার মুখে আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ব্যস, আর দেখতে হবে না। সেদিন হয় তোমার পকেটমার হবে, নয়তো পচা মাছ বা কানা বেগুন গছিয়ে দেবে ব্যাপারিরা, নয়তো ষাঁড়ে গুঁতিয়ে দেবে।”
সুবুদ্ধি চোখ গোল-গোল করে বলল, “আজ্ঞে, তাই তো হয়েছে।”
কার্তিক বলল, “আর আমার কিছু কম হয়েছে?”
গোবিন্দ বিশ্বাস বেশ অহঙ্কারের সঙ্গে বলল, “আরে ও তো কিছু নয়, ধরো আজ তোমার একটা গুরুতর মামলার রায় বেরোবে, মামলাটার ধরো, তোমার দিকেই পাল্লা ভারী, জিতবেই কি জিতবে। বেরোবার মুখে আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ব্যস, মামলার রায় ঘুরে যাবেই কি যাবে।”
সুবুদ্ধি আতঙ্কিত হয়ে বলল, “বটে?”
“গ্যারান্টি দিই ভায়া। আর সেইজন্যই তো আজকাল আমাকে হায়ার করতে মেলা দূর-দূর থেকেও লোক আসে। মোটা ফি দিয়ে নিয়ে যায়।”
সুবুদ্ধি ক্যাবলাকান্তের মতো বলল, “হায়ার করে কেন?”
“করবে না? ধরো তোমার কাউকে জব্দ করা দরকার। আমার কাছে এসে টাকা ফেলে তোমার শত্রুর নাম-ঠিকানা দিয়ে যাও। পরদিন সকালে ঠিক আমি তার বাড়ির সামনে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকব। যেই বেরোবে অমনই তার সামনে গিয়ে হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে যাব। আজ অবধি একটাও ফেলিওর নেই। ফিও বাড়িয়ে দিয়েছি। ছোটখাট কাজও আজকাল হাতে নিই না। এই তো রামবাবুর সঙ্গে অবিনাশবাবুর খুব মনকষাকষি। রামবাবুর ছেলে অবনী প্রতি বছর পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। অবিনাশবাবু সেবার অবনীর পরীক্ষার ফল বেরোবার আগের দিন এসে আমাকে হায়ার করার জন্য ঝুলোঝুলি, যেন পরদিন সকালে অবনীকে একটু দেখা দিয়ে আসি। তা আমি রাজি হইনি। বড় ছোট কাজ। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে আছে? অবিনাশ তখন হাতে দু হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এ কাজটা না করলে আমি আত্মহত্যা করব।’ তা কী আর করা। গেলুম। অবনী ইস্কুলে যাওয়ার মুখে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললুম, ‘কী, রেজাল্ট জানতে যাচ্ছ? ভাল, ভাল’।“
সুবুদ্ধি চোখ গোল করে বলল, “তারপর কী হল?”
“বললে বিশ্বাস হবে না ভায়া, যে ছেলে অঙ্কে একশোতে একশো ছাড়া পায় না, সেই ছেলে অঙ্কে পেল আট, ইংরেজিতে একুশ, ভূগোলে এগারো, আর বাংলায় পঁচিশ।”
“বলেন কী?”
“কী বলব ভায়া, নিজের এলেম দেখে আমি নিজেই তাজ্জব!”
“আপনি তো দাদা, সাঙ্ঘাতিক লোক!”
গোবিন্দ বিশ্বাস হঠাৎ মুখোনা গম্ভীর করে বলল, “সাঙ্ঘাতিক বটে, তবে আমার জীবনটা ভারী দুঃখের। সেই ছেলেবেলা থেকে সবাই অপয়া-অপয়া বলে পেছনে লাগত, কেউ মিশতে চাইত না! আমার কোনও বন্ধুও ছিল না। তারপর বড় হলাম, চুঁচুড়ো আদালতে চাকরিও পেলুম, কিন্তু কপালের দোষে সবাই টের পেয়ে গেল যে আমি অপয়া। লোকে ঘেন্নাটেন্নাও করত। তারপর ধীরে ধীরে অপয়ার কদর হতে লাগল। পয়সাকড়ি পেতে শুরু করলুম। তারপর চাকরি ছেড়ে এখন দিব্যি আছি। মুখ দেখালেই পয়সা।”
সুবুদ্ধি অবাক হয়ে বলে, “যত শুনছি তত অবাক হচ্ছি। এরকমও হয় নাকি?”
“হয় না? এই তো আজই সকালে আমার মুখ দেখে তোমার কেমন হেনস্থাটা হল বলো। বেশি কথা কী। বর্ধমান কর্ড লাইনে বেলমুড়ি বলে একটা স্টেশন আছে। নামটা নিয়েছ কি বিপত্তি একটা হবেই। ও-লাইনের লোকেরা নামটা উচ্চারণও করে না। বলে মাঝের গ্রাম। এমনকী হাওড়ার টিকিটবাবুরা অবধি।”
“আজ্ঞে, আমি এদিককার লোক নই, তাই ও-জায়গার নাম শুনিনি। তবে আপনার ওপর ভারী শ্রদ্ধা হচ্ছে।”
“হতেই হবে। সারা পরগনার লোক আমাকে ভয় খায়। এই যে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যারা যায় তারা চোখ বুজে যায় কেন এবার বুঝলে তো?”
“আজ্ঞে খুব বুঝেছি, জলের মতো পরিষ্কার।”
“তবে কী জানেনা ভায়া, আমার এলেম বেলা বারোটা অবধি। তারপর আর আমার অপয়া ভাবটা থাকে না। আবার ভোর থেকে শুরু হয়। তামাম দিন অপয়া ভাবটা থাকলে আরও মেলা রোজগার করতে পারতুম।”
সুবুদ্ধি খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, “আপনার ওপর ভারী ভক্তি হচ্ছে আমার।”
“হবে না? হওয়ারই কথা কিনা, ভক্তি বলো, ভয় বলো, যা হোক একটা কিছু হলেই হল। মোদ্দা কথা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা চলবে না। সকালবেলাটায় এই বারান্দায় এসে কেন দাঁড়িয়ে থাকি জানো? এটা হল আমার নেট প্র্যাকটিস। লোকেরা আমাকে ঠিকমতো মান্যগণ্য করছে কিনা, যথেষ্ট খাতির দেখাচ্ছে কিনা তা লক্ষ করা। তবে আজকাল অনেকেই এ রাস্তা ছেড়ে খালধার বা বটতলা দিয়ে ঘুরে বাজারে যায়। দিনদিন এ রাস্তায় লোক-চলাচল কমে আসছে। তা সেটাও ভাল লক্ষণ। আমার নামডাক আরও বাড়ছে, কী বলো?”
সুবুদ্ধি খুবই গদগদ হয়ে বলল, “তা তো বটেই!”
লোকটা খ্যাঁচ করে হেসে বলল, “দরকার হলে বোলো ভায়া, তুমি আমার কাছের লোক, কম পয়সায় কাজ উদ্ধার করে দেব। বেলা বারোটা বাজে, আমার চান-খাওয়ার সময় হল। আজ আবার ইলিশ মাছ হয়েছে কিনা। গলদা চিংড়িও আছে। যাই তা হলে?”
“আজ্ঞে আসুন। আলাপ করে বড় ভাল লাগল।”
গোবিন্দ বিশ্বাস ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার পর কার্তিক বলল, “এ তো সাঙ্ঘাতিক লোক মামা! এর পাশে থাকা কি ঠিক হবে? তুমি বাড়ি বেচে দাও।”
সুবুদ্ধি করুণ মুখে বলল, “আমি আহাম্মক বলে কিনেছি। যারা জানে তারা এ বাড়ি কি কস্মিনকালেও কিনবে?”