“ওরে কার্তিক, বাড়ির মেঝে যে ফোঁপরা হয়ে গেছে রে! রাত-বিরেতে আমাদের নিয়ে ধসে পড়বে না তো!”
“না মামা, না। এ-জায়গাটায় বোধ হয় গুপ্তধনটন আছে, তাই ফাঁপা।”
“তোর মাথা। “
সুবুদ্ধি মুখে রাগ দেখালেও মনে-মনে ঠিক করে ফেলল এখানে থাকাই যুক্তিযুক্ত। বাজারে যে-ঘর ভাড়া নিয়েছে সেখানে জায়গা বড় কম, বাথরুমও নেই। এখানে থাকলে সেদিকে সুবিধে।
পরদিন বাজারে গিয়ে তারা দুটো চৌকি কিনে ফেলল। তারপর জিনিসপত্র নিয়ে এসে ঘরদোর সাজিয়ে ফেলল।
কার্তিক হঠাৎ বলল, “আচ্ছা মামা, একটা জিনিস লক্ষ করেছ?”
“কী?”
“এ-পাড়াটা অন্ধদের পাড়া।”
“বলিস কী?”
“একটু আগে সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। দেখলুম সব লোক চোখ বুজে হাতড়ে হাতড়ে হাঁটছে। এমনকী একটা রিকশাওলা পর্যন্ত চোখ বুজে পক-পঁক করে হর্ন দিতে দিতে চলে গেল।”
“ঠিক দেখেছিস?”
“বিশ্বাস না হয় চলো, তুমিও দেখবে।”
বাইরে এসে সুবুদ্ধি দেখল, কথাটা ঠিকই, রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছে কেউ চোখে দেখে না, সবাই সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে পা ঘষটে-ঘষটে হাঁটছে। একটা লোক সাইকেলে করে গেল, তারও চোখ বোজা।
সুবুদ্ধি ফের হতবুদ্ধি হয়ে বলল, “এ কী ব্যাপার রে? এখানে এত অন্ধ মানুষ থাকে নাকি?”
“তাই তো দেখছি।”
“এ তো বড় ভয়ের কথা হল রে কার্তিক। নন্দপুরের এত লোক অন্ধ কেন, তার একটু খোঁজ নিতে হচ্ছে। এখানে নিশ্চয়ই কোনও খারাপ চোখের রোগের প্রকোপ আছে। শেষে যদি আমাদেরও এই দশা হয়?
ঠিক এমন সময় খ্যাঁচ করে একটা হাসির শব্দ হল। সুবুদ্ধি ডান দিকে ফিরে দেখল, পাশের বাড়ির বারান্দায় একটা লোক দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে হাসছে। লোকটার মাথায় টাক, মোটা গোঁফ, রোগা চেহারা। সুবুদ্ধির চোখে চোখ পড়তেই বলল, “ভায়া কি নতুন এলে নাকি?”
“যে আজ্ঞে।”
“নতুন লোক দেখলেই বোঝা যায়, এখনও নন্দপুরের ঘাঁতঘোঁত বুঝে উঠতে পারোনি না?”
“আজ্ঞে না!”
“বাড়িটা কিনলে বুঝি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আচ্ছা মশাই, এখানে কি খুব চোখের রোগ হয়?”
লোকটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “চোখের রোগ? না তো?”
“তা হলে এত অন্ধ কোথা থেকে এল?”
লোকটা ফের খ্যাঁচ করে হাসল, “অন্ধ কে বলল? ওরা তো সব চোখ বুজে হাঁটছে।”
“চোখ বুজে হাঁটছে! কেন মশাই, চোখ বুজে হাঁটছে কেন?”
“বাঃ, আমি দাঁড়িয়ে আছি না?”
সুবুদ্ধির বুদ্ধি গুলিয়ে গেল, সে বলল, “আপনি দাঁড়িয়ে আছেন তো কী!”
“নন্দপুরে নতুন এসেছ, বুঝতে একটু সময় লাগবে।” বলেই লোকটা ফের খ্যাঁচ করে হাসল। হাসিটা মোটেই ভাল ঠেকল না সুবুদ্ধির কাছে। সে কার্তিকের দিকে চেয়ে বলল, “কিছু বুঝছিস?”
“না মামা।”
“আমিও না।”
তার ঘণ্টাখানেক পরেই পুরোটা না হলেও খানিকটা বুঝল সুবুদ্ধি। বাজারে আজ তার পকেটমার হল। আর ষাঁড় তাড়া করায় পড়ে গিয়ে হাঁটুতে বেশ চোট হল। আর মামা-ভাগ্নে মিলে খাবে বলে যে দুটো মাগুর মাছ কিনেছিল তা চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কার্তিকেরও বড় কম হল না। সুবুদ্ধি বাজারে যাওয়ার পর সে ঝুল-ঝাড়নি দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করতে গিয়ে বে-খেয়ালে একটি বোলতার বাসায় খোঁচা মারতেই গোটা চার-পাঁচ বোলতা রেগেমেগে এসে তার কপালে আর গালে হুল দিয়ে গেল। একটা কুকুর এসে নিয়ে গেল একপাটি চটি। আর কুকুরটাকে তাড়া করতে গিয়ে রাস্তায় একটা চোখ-বোজা লোকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চিতপটাং হতে হল।
হয়রান আর ক্লান্ত হয়ে সুবুদ্ধি যখন বাজার থেকে ফিরল তখন কার্তিক বিরস মুখে বারান্দায় বসে আছে। ভাগ্নেকে দেখে সুবুদ্ধি বলে উঠল, “আর বলিসনি, ষাঁড়ে এমন তাড়া করেছিল…”
“রাখো তোমার ষাঁড়, বোলতার হুল তো খাওনি…”
“বোলতা কোথায় লাগে! কড়কড়ে পাঁচশো বাইশ টাকা চলে গেল পকেট থেকে…”
“আর আমার চটি? তার কথা কে বলবে?”
“দু-দুটো মাগুর মাছ চিলে নিয়ে গেল হাত থেকে জানিস?”
“আর আমার যে মাথায় চোট!”
মামা-ভাগ্নে বারান্দায় পাশাপাশি বসে যখন এসব কথা বলছিল তখন আবার সেই খ্যাঁচ করে হাসির শব্দ! পাশের বাড়ির বারান্দায় সেই গুঁফো, টেকো, রোগা লোকটা দাঁড়িয়ে বড় বড় দাঁত বের করে হাসছে। বলল, “কী ভায়া, বড্ড যে বেজার দেখছি! বলি হলটা কী?”
সুবুদ্ধি মলিন মুখ করে বলল, “বড় বিপদ যাচ্ছে দাদা।”
লোকটা ভারী আহ্বাদের হাসি হেসে বলল, “যাচ্ছে? বাঃ বাঃ! এবার তা হলে দেখলে তো!”
“কী দেখব?”
“কিছু বুঝতে পারোনি?”
“আজ্ঞে না।”
“হেঃ হেঃ, তা হলে তো তোমাকে বেশ বোকাসোকাই বলতে হয়। জলের মতো সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না?”
সুবুদ্ধি মাথা চুলকে বলল, “ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে মাথাটা ভোঁ হয়ে গেছে। বুদ্ধিটা কাজ করছে না।”
“আরে বাবা, সাধে কি আমার এত নামডাক? শুধু এ-তল্লাট নয়, গোটা পরগনা ঘুরে দেখে এসো, এ শর্মাকে সবাই একডাকে চেনে কি না!”
সুবুদ্ধি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তা হলে আপনি একজন কেউকেটা লোকই হবেন বোধ হয়?”
“তা বলতে পারো। আজকাল দু পয়সা বেশ রোজগারও হচ্ছে আমার। রোজ বড় পোনা মাছ রান্না হয় আমার বাড়িতে, ভাতের পাতে ঘি না হলে আমার চলেই না, রাতে মাংস আর ক্ষীর একেবারে বাঁধা। তা কী করে এসব হয়, তা জানো?”
সুবুদ্ধি মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে না।”
“শুনতে চাও?”
“যে আজ্ঞে।” সুবুদ্ধি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল।