ভারী হতাশ হয়ে ভূতনাথ বললেন, “আমার যে তর সইছে।”
“আরে বাপু, আয়ু তো দু’দিনের। তারপর হাতে দেখবে অফুরন্ত সময়। রিভলভারটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলো তো বাপু! আমি চললুম।”
“যে আজ্ঞে।”
অঘোর সেন যে চলে গেলেন তা টের পেলেন ভূতনাথ। একটা শ্বাসের মতো শব্দ ঘর থেকে ফুস করে যেন বেরিয়ে গেল। ঘড়ি দেখে ভূতনাথ চমকে উঠলেন। সর্বনাশ! পৌনে চারটে বাজে! রাত শেষ হতে তো আর দেরি নেই!
তিনি হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে উঠে পড়লেন। সুড়ঙ্গের মুখে মই লাগানো হয়েছে। সেটা বেয়ে ওপরে উঠে যা দেখলেন তাতে
তাঁর একগাল মাছি। বেশিরভাগ.পাহারাদারই শুয়ে বা বসে গভীর
নিদ্রাভিভূত। দারোগাবাবুর নাক ডাকছে। জেগে আছে, শুধু সুবুদ্ধি, সমাজ মিত্তির আর দু-চারটে লোক। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, “শিগগির সনাতনবাবুকে ডাকো তোমরা। আর সময় নেই।”
চেঁচামেচিতে সবাই জেগে গেল। স্বয়ং গোবিন্দবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, “কী হয়েছে? সনাতনদাদু তো ঘুমোচ্ছেন।”
“ঘুমোচ্ছেন! দেড়শো বছর ঘুমিয়েও আবার ঘুম?”
“আজ্ঞে, পরোটা আর মাংস খাওয়ার পর তাঁর ভারী ঘুম পেয়ে গেল যে!”
“শিগগির তাঁকে তুলুন। নইলে রক্ষে নেই।”
অনেক ডাকাডাকির পর সনাতন উঠে বাইরে এসে হাই তুলে বললেন, “প্রাতঃকালেই ডাকাডাকি কেন হে?”
“আজ্ঞে, আপনিই ভরসা।”
“কী করতে হবে, বলো তো বাপু?”
“কী করতে হবে, তা জানি না। দয়া করে একটু পাতালঘরে এসে বসুন।”
“না হে বাপু, আর পাতালঘরে নয়। ওখানে গেলে যদি ফের ঘুমিয়ে পড়ি?”
“সে-ভয় নেই। দয়া করে আসুন।”
সাড়ে তিনটের সময় যখন লোকটা দেখল পাহারা শিথিল, সবাই ঘুমে ঢুলছে, তখন সে ধীরে-ধীরে হোগলার বন ভেদ করে ওপরে উঠে এল। খুবই নিঃশব্দ তার চলাফেরা।
গাড়ির পেছনকার বাগানের পাঁচিলটা ডিঙিয়ে সে ঢুকে পড়ল
ভেতরে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগোতে লাগল।
হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে উঠল কার নাম ধরে। অনেক লোক জেগে উঠল। পাশের বাড়ি থেকে দুটো লোক এ বাড়িতে এসে ঢুকল। লোকটা একটু অপেক্ষা করল। গোলমালটা থিতিয়ে আসতেই সে নিঃশব্দ পদচারণায় বাড়ির পেছনের একটা দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। হাতের সামান্য একটু কলাকৌশলেই খুলে গেল দরজা। সে ভেতরে ঢুকল।
সামনেই একটা লোক। তাকে দেখে চেঁচানোর জন্য হাঁ করেছিল। লোকটা তাকে সামান্য একটা কানা মারতেই লোকটা আলুর বস্তার মতো পড়ে গেল মেঝের ওপর।
সুড়ঙ্গর পথ তার চেনা। সে নিঃশব্দে গিয়ে গর্তটার সামনে দাঁড়াল। তারপর নামতে লাগল নীচে।
পাতালঘরের দরজাটা বন্ধ। লোকটা হাতের ধাক্কায় দরজার পাল্লা ছিটকে দিয়ে খোলা দরজায় দাঁড়াল। নীচে দুটো লোক ভীত মুখে ঊধ্বদিকে চেয়ে আছে।
দু’জনের একজন হঠাৎ তাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “ওই… ওই হল হিকসাহেব! ও আসলে ভূত! ও কৌটোয় করে আকাশ থেকে নেমে আসে… ওরে বাবা…”
লোকটা ওপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ল।
লোকটার জীবনে যা কখনও হয়নি, যে অভিজ্ঞতা তার সূদূর কল্পনারও অতীত, লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই ঘটল। মেঝের ওপর পড়তেই তার বাঁ হাঁটুটা বেকায়দায় বেঁকে গেল। তারপর মচাৎ করে একটা শব্দ। লোকটা এক অজানা ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল, “সাব সি! সাব সি!”
তারপর যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বাঁ হাঁটু চেপে ধরে বসে রইল। ভূতনাথবাবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “ভূ-ভূত হলে কি অমন
আর্তনাদ করত? ভূত কি ব্যথা পায়?”
সনাতন বিশ্বাস হঠাৎ বলে উঠল, “দাঁড়ান মশাই, মনে পড়েছে। ওই কোণের দিকে টেবিলে একটা শিশি আছে। হিক শিশিটা দেখে কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল।”
সনাতন দৌড়ে গিয়ে শিশিটা নিয়ে এল। তাতে তেলের মধ্যে ভেজানো একটা মরা তেঁতুলবিছে। অনেকে বাড়িতে রাখে।
“ওটা কী মশাই?”
“তেতুঁলবিছে হুল দিলে এই তেল লাগালে উপকার হয়।”
“ওতে ভয় পাওয়ার কী আছে?”
“কে জানে মশাই!”
বলে শিশিটা নিয়ে সনাতন বিশ্বাস লোকটার দিকে এগিয়ে যেতেই ভাঙা পা নিয়ে বিবর্ণ মুখে লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলল, “খবরদার! খবরদার! ওটা সরিয়ে নে!”
সনাতন হেঃ হেঃ করে হেসে বলল, “এবার বাছাধন?”
লোকটা, অর্থাৎ হিকের ছেলে ভিক হঠাৎ অমানুষিক একটা চিৎকার করে এক লম্ফে ওপরের ফোকরটার কানা ধরে ঝুল খেয়ে ওপরে উঠে পড়ল। আর ঠিক সেই সময়ে ওপর থেকে একটা পাথর আলগা হয়ে খসে পড়ল তার মাথায়। তবু চেঁচাতে-চেঁচাতে লোকটা ওপরে উঠে পড়ল। সুড়ঙ্গ বেয়ে রাস্তায় নেমে ভাঙা পা নিয়েই সে এমন দৌড় লাগাল, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
সনাতন শিশিটা রেখে দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, “হুঁ, গোবিন্দ আবার অপয়া! ছেলেমানুষ মশাই, ছেলেমানুষ। আমি এমন অপয়া ছিলাম যে, কুকুর-বেড়াল অবধি আমার পথে হাঁটত না।”
ভূতনাথ গদগদ স্বরে বললেন, “দিন মশাই, পায়ের ধুলো দিন।”