অঘোর সেন এক আশ্চর্য লোক। এত বড় একটা কাজ করলেন কিন্তু এক্সপেরিমেন্টের কোনও লিখিত বিবরণ রেখে যাননি। বৈজ্ঞানিকদের ধর্ম অনুযায়ী এরকম একটা বিবরণ রেখে যাওয়া তাঁর খুবই উচিত ছিল না কি?
“ছিলই তো!” কে যেন বলে উঠল।
ভূতনাথ গভীর চিন্তার মধ্যে বিচরণ করতে করতে বললেন, “তা হলে লিখে রাখলেন না কেন?” “হিক সাহেব রাখতে দিল না যে!”
এবার ভূতনাথ একটু অবাক আর সচকিত হয়ে চারদিকে চাইলেন। ল্যাবরেটরিতে তিনি একাই আছেন। তা হলে কথাটা বলছে কে? প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় চারদিকটা বেশ ফটফট করছে। তবু তিনি হাতের জোরালো টর্চটা জ্বেলে চারপাশে দেখে নিয়ে বললেন, “নাঃ, আমারই মনের ভুল।”
“ভুল নয়, হে, ভুল নয়। ঠিকই শুনেছ।” কেউ নেই, অথচ তার কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে এরকম ঘটনা তাঁর জীবনে আগে কখনও ঘটেনি। তিনি একটু ভয় খেয়ে বলে উঠলেন, “আপনি কে কথা বলছেন? কাউকে যে দেখছি না!”
“দেখতে চাও নাকি?” ভূতনাথ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “আ-আপনি কি ভূ-ভূত?”
গলাটা খিঁচিয়ে উঠল, “ভূত আবার কী হাঁ? বিজ্ঞান শিখেছ আর এইটে জানো না যে, সব জিনিসেরই বস্তুগত রূপান্তর হয়?”
“আজ্ঞে, তা জানি।”
“তা হলে ভূত বলে তাচ্ছিল্য করার কী আছে?”
“তাচ্ছিল্য করিনি তো?”
“করেছ। তুমি ভূতটুত মানো না, আমি জানি।”
“আজ্ঞে মানছি, এখন থেকে মানছি। আপনি কে?”
“আমিই অঘোর সেন।”
ভূতনাথ আঁ-আঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়তে-পড়তেও সামলে গেলেন। হাতজোড় করে বললেন, “আমার হার্ট দুর্বল। আমাকে আর ভয় দেখাবেন না।”
“তোমার মতো নাস্তিককে ভয় দেখাতে এসেছি বলে ভেবেছ। নাকি? আমার অত সময় নেই। তোমাদের বিপদ বুঝেই আসতে হল। একগাদা মর্কট মিলে ওপরে তো কীর্তনের আসর বসিয়ে ফেলেছ প্রায়। হিক সাহেবের ছেলেকে কি ওভাবে আটকানো যায়?”
ভূতনাথ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “হিক সাহেব কে?”
“সপ্তর্ষি চেনো?”
“যে আজ্ঞে!”
“ওই মণ্ডলেরই বাসিন্দা। অনেকদিন ধরেই যাতায়াত। ওহে বাপু, তুমি যে কেঁপে-ঝেপে একশা হলে। ভয় পাচ্ছ নাকি?”
“ওই একটু।”
“তা ভয়ের কী আছে বলো তো! টেপরেকডারে, গ্রামোফোনে অন্যের গলা শোনো না? তখন কি ভয় পাও? অনেক মৃত গায়কের গানও তো শোনো। তখন তো ভিরমি খাও না!”
“আজ্ঞে, সে তো যন্ত্রে রেকর্ড করা থাকে।”
“কিন্তু সেও তো ভূত, নাকি? সেও তো অতীত, যা নাকি এখন নেই। ঠিক তো!”
“আজ্ঞে।”
“ফোটো দেখো না? ফোটোতে কত শতায়ু মানুষের ছবিও তো দেখো, তখন ভয় পাও?”
“আজ্ঞে, সে তো ইমপ্রেশন।”
“ভাল করে বিজ্ঞানটা রপ্ত করো, তা হলে ভূতপ্রেতও বুঝতে পারবে, বুঝেছ? এসবও ইমপ্রেশন, এসবও সূক্ষ্ম অস্তিত্ব, তবে কিনা বিজ্ঞান এখনও নাগাল পায়নি এই রহস্যের।”
“যে আজ্ঞে!”
“শোনো বাপু, একটা কথা বলতে এই এতদূর আসা। অনেক দূরে থাকি, নানা কাজকর্মও করতে হয়। পরলোক বলে বসে শুয়ে জিরিয়ে সময় কাটানোর উপায় নেই। তবু তোমাদের বিপদের খবর পেয়েই আসতে হল।”
“যে আজ্ঞে।”
“হিক সাহেবের ছেলে পেছনের জলায় ঘাপটি মেরে আছে।”
“সর্বনাশ! তা হলে লোকজনকে খবর দিই?”
“আহাম্মকি করতে চাইলে দিতে পারো। তবে যদি ঘটে বুদ্ধি থেকে থাকে, ওকাজ করতে যেও না। ওর নাম ভিক। ও একাই গাঁসুন্ধু লোককে মেরে ফেলতে পারে।”
“তা হলে কী করব?” গলাটা খেচিয়ে উঠল ফের, “তার আমি কী জানি?”
“তবে যে বললেন, বিপদ দেখে এসেছেন!”
“তা তো এসেছিই। কিন্তু ভূত বলে কি আর আমি সবজান্তা?”
“যে আজ্ঞে।“
“শোনো বাপু, গতিক আমি সুবিধের বুঝছি না। হিকের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল সনাতনের যেদিন ঘুম ভাঙবে সেদিনই সে তার ‘রেসপিরেটর’ আর ‘রিভাইভার’ যন্ত্র সমেত সনাতনকেও নিয়ে যাবে।”
“বটে! তা হলে আমরা আপনার এত বড় আবিষ্কারের কোনও ফলই পাব না?”
“পেয়ে করবেটা কী? লোকে জানতে পারলেই সব ঘুমোতে চাইবে। মরার চেয়ে ঘুম যে অনেক ভাল বলে মনে করে সবাই।”
ভূতনাথ মাথা চুলকে বললেন, “তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আবিষ্কারটা যে মাঠে মারা যাবে।”
“তা যাবে। হিক সাহেব ছাড়বার পাত্র নন। সনাতন যে জেগেছে সে-খবর তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে। তাই ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
“তা হলে কী করা যায় বলুন তো!”
“ভাল করে শোনো।”
“শুনছি।”
“সনাতন খুব পাজি লোক, তা জানিস?”
“আজ্ঞে না। কীরকম পাজি?”
“কীরকম পাজি তা বলা মুশকিল। আমিও জানি না, তবে গাঁয়ের লোক ওকে ভয় পেত।”
“যে আজ্ঞে।”
“তোমরা ওকেই কাজে লাগাও।”
“কীভাবে?”
“তা আমি জানি না। যা মনে এল বললাম। এখন আমি যাচ্ছি। অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জে আমার জরুরি কাজ আছে। সেখানে আজ আর্কিমিডিস বক্তৃতা দেবেন।”
“বলেন কী? আর্কিমিডিস? এ যে ভাবা যায় না!”
“না ভাববার কী আছে! হরবখত দেখা হচ্ছে ওঁদের সঙ্গে। আর্কিমিডিস, নিউটন, গ্যালিলেও।”
“অ্যাঁ!” বলে মস্ত হাঁ করে রইলেন ভূতনাথ। তারপর হঠাৎ পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “স্যর, একটু দাঁড়ান। আমিও আপনার সঙ্গে আর্কিমিডিসের বক্তৃতা শুনতে যাব। এ সুযোগ ছাড়া যায় না।”
“তা বলে মরবে নাকি?”
“না মরলে তো উপায় দেখছি না। একটা মিনিট দাঁড়ান। পিস্তলের ঘোড়া টিপলেই এক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসব।”
“আ মলো! এ তো আচ্ছা পাগল দেখছি! ওহে বাপু, আর্কিমিডিসের বক্তৃতা মেলা শুনতে পাবে। বেঁচে থেকে যা-যা করার, ঠিকমতো আগে করো, নইলে বিজ্ঞানলোকে আসবার পাসপোর্ট হবে না যে!”