জলাজমির প্রান্তে হোগলার বন। লোকটা হোগলার বনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বাড়ির পেছনদিকটা লক্ষ করল। পেছনে জলাজমি বলে ওরা এদিকে পাহারা কম রেখেছে। কারণ জলাজমি দিয়ে কোনও মানুষের পক্ষে হানা দেওয়া সম্ভব নয়। পেছনে মাত্র তিনজন লোক পাহারায় আছে।
এই গ্রহের প্রাণীদের শরীর দুর্বল, প্রাণশক্তিও কম। এদের অস্ত্রশস্ত্রগুলি হাস্যকর। লোকটা ইচ্ছে করলে এদের সব ক’জনকেই ঘায়েল করে কার্যোদ্ধার করতে পারে। কত লোককে হত্যা করতে হবে তা সে জানে না। সে শুধু জানে, সব কাজেরই একটা সময় আছে।
তার চারদিকে লক্ষ-লক্ষ মশা ওড়াউড়ি করছে, গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে জলজ সাপ, জোঁক কিলবিল করছে চারদিকে, ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ছে গায়ে। তার ভূক্ষেপ নেই। সে হিসেব করে দেখল, আরও কয়েক ঘণ্টা পর, বিশেষ করে ভোরের দিকে এই মানুষগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এদের ঘুম পাবে, শিথিল হয়ে যাবে সতর্কতা। এখনই সময়। সুতরাং তাকে অপেক্ষা করতে হবে। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
দারোগা হরকান্ত পোদ্দার রাত্তিরবেলা বিশেষ কিছু খান না। পাঁঠার কালিয়া আর ঘিয়ে ভাজা পরোটা। তা তাঁর জন্য আজ গোবিন্দ বিশ্বাসের বাড়িতে তাই রান্না হচ্ছে। হরকান্ত পোদ্দার বাইরে একখানা কাঠের চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে তাঁর দারোগা-জীবনের নানা বীরত্বের কাহিনী বর্ণনা করছেন। সবাই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে। দু’জন বন্দুকধারী কনস্টেবল ভিড় সামলাচ্ছে।
হরকান্ত পোদ্দার সুবুদ্ধি আর দ্বিজপদর দিকে চেয়ে বললেন, “তোমরা বলছ, লোকটার গায়ে খুব জোর! ওরে বাবা, যত জোরই থাক ট্যারা পালোয়ানের চেয়ে তো আর সে তাকওয়ালা লোক নয়! মোহনপুরের জঙ্গলে সেই ডাকু ট্যারা পালোয়ানের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই হল সেবার। তা লড়েছিল খুব। কিন্তু পারবে কেন? শেষে তাকে কোমরের বেল্ট দিয়ে একস্টা শালগাছের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম। লোকটা সেলাম ঠুকে বলেছিল, আপনার মতো মস্তান দেখিনি কখনও।’ নাড় গুণ্ডার নাম শুনেছ? বাহাত্তর ইঞ্চি বুকের ছাতি, দুখানা হাত ছিল এক জোড়া শাল খুঁটি, আস্ত খাসি খেয়ে ফেলত এক-একবার। সেই নাড়কে যখন ধরতে গেলুম তখন কী ফাঁইটিংটাই না হল। হিন্দি সিনেমার ফাঁইটিং তার কাছে নস্যি। নাড স্বীকার করেছিল, ‘হ্যাঁ, ওস্তাদ বটে! বুঝেছ?”
সুবুদ্ধি আর দ্বিপদ ঘাড় নাড়ল বটে, কিন্তু তারা হরকান্ত দারোগার উপস্থিতিতে বিশেষ ভরসা পেয়েছে বলে মুখের ভাবে প্রকাশ পেল না। হরকান্তর চেহারা দশাসই, সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক তেল-ঘি, মাংস-মাছ খেয়ে চেহারাটা বড়ই বিপুল। এ-চেহারায় ফাঁইটিং করতে গেলে কী কাণ্ড হবে কে জানে!
সনাতন বিশ্বাস বা অঘোর সেনের ল্যাবরেটরির কথা এখনও কাউকে জানায়নি তারা। শুধু প্রচার হয়েছে একটা ডাকাত আজ হামলা করতে আসছে। নন্দপুরে বহুকাল কোনও উত্তেজক ঘটনা ঘটেনি। তাই গাঁ ঝেটিয়ে লোক এসেছে।
সনাতন বিশ্বাসকে গোবিন্দ তাঁর বাড়ির একেবারে অন্দরমহলে লুকিয়ে রেখেছেন। নিজের বংশধরদের মধ্যে এসে, সনাতন দুঃখের মধ্যেও কিছুটা সুখ পাচ্ছেন। গোবিন্দ বিশ্বাসের বউকে তিনি বলেছেন, “বউমা, এখন একটাই অসুবিধে। দেড়শো বছর টানা ঘুমিয়েছি, এখন কি আর আমার ঘুমটুম হবে?”
সমাজ মিত্তির তাঁর মোটা লাঠিটা হাতে নিয়ে চারদিকে ঘুরে দেখছেন এবং লোকটা হাজির হলে কী করা হবে তার স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছেন।
মাটির নীচে পাতালঘরে ভূতনাথ একা অবস্থান করছেন। তাঁর কপালে ভ্রূকুটি। তিনি বুঝতে পারছেন, অঘোর সেনের এই ল্যাবরেটরি দেড়শো বছর আগেকার প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হয়নি। এতে উন্নত বিজ্ঞানের অবদান আছে। এবং সেই বিজ্ঞান এই পৃথিবীর বিজ্ঞান নয়। হিক সাহেবের কথা তিনি শুনেছেন। বিচার-বিশ্লেষণ করে অনুমান করতে পারছেন যে, এই হিক সাহেবই সেই উন্নত বিজ্ঞানের সরবরাহকারী। আর এও বুঝতে পারছেন, যে লোকটি হামলা করছে সে এসেছে প্রমাণ লোপ করতে এবং কিছু জিনিস বা যন্ত্রপাতি ফেরত নিয়ে যেতে। সম্ভবত সে সনাতন বিশ্বাসকেও নিয়ে যাবে, যাতে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকরা রহস্যটা ভেদ করতে না পারে।
অনেক ভেবে ভূতনাথ হতাশায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটা লোক, কিন্তু সে অমিতবিক্রমশালী। তাঁরা যে পাহারা বসিয়েছেন তা দিয়ে লোকটাকে রোখা যাবে কি না সে-বিষয়ে তাঁর ঘোর সন্দেহ আছে। তিনি আজ কলকাতায় গিয়ে তাঁর রিভলভারটা নিয়ে এসেছেন, দারোগা এবং কনস্টেবলদের কাছেও বন্দুক-পিস্তল আছে। কিন্তু এগুলো তাঁর যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। তাঁর ভয় এবং দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
ভূতনাথ ল্যাবরেটরিটা খুব ভাল করে ঘুরেফিরে দেখেছেন। শিশি-বোতলের তরল পদার্থগুলোও কিছু কিছু পরীক্ষা করেছেন। বেশিরভাগই পরিচিত রাসায়নিক পদার্থ। তবে সনাতনের বাক্সে যে-শিশিটা রাখা আছে তার ভেতরকার দ্রব্যটা তাঁর পরিচিত জিনিস নয়। অমৃতবিন্দুর একটা পাত্র রয়েছে, সেটাও তাঁর চেনা জিনিস নয়। তবে সবকিছুই ফের ভাল করে ল্যাবরেটরি টেস্ট করা প্রয়োজন। নইলে দেড়শো বছর ধরে একটা লোককে ঘুম পাড়িয়ে রাখার রহস্যটা বোঝা যাবে না। পৃথিবীর বিজ্ঞানে এরকম ঘটনার কল্পনা করা হয় বটে, কিন্তু হাতে কলমে এমন অত্যাশ্চর্য ঘটনার প্রমাণ তো সারা দুনিয়ায় তোলপাড় ফেলে দেবে। কিন্তু সেই সুযোগ কি পাওয়া যাবে?