সমাজ মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “না হে, নন্দপুরে ব্যায়ামবীর কেউ আছে বলে জানি না। ক্যারাটের নামও কেউ শুনেছে কি না সন্দেহ।”
“আচ্ছা, কার কার বাড়িতে বন্দুক-পিস্তল আছে বলুন তো!”
“না রে বাপু, গাঁয়ের লোকের অত পয়সা কোথায়? যদু সামন্তর একটা গাদা বন্দুক ছিল, তাও বহু পুরনো। সেদিন দেখলুম যদু সামন্তর নাতবউ সেটা দিয়ে নর্দমা পরিষ্কার করছে।”
“তা হলে তো চিন্তার কথা!”
৫. নন্দপুরের পুবপাড়া যেখানে শেষ হয়েছে
নন্দপুরের পুবপাড়া যেখানে শেষ হয়েছে তার পর থেকে ঘোর জঙ্গল, দিনের বেলাতেও জায়গাটা অন্ধকার। দেড়শো বছর আগে একসময়ে এখানে কুখ্যাত তারা তান্ত্রিকের ডেরা ছিল। জনশ্রুতি আছে এখানে নিয়মিত নরবলি হত। জঙ্গলের একেবারে ভেতরে নিবিড় বাঁশবনের মাঝখানে পুরনো পরিত্যক্ত একখানা কালীমন্দির। মন্দিরের বেশিরভাগই ভেঙে পড়েছে। সাপখোপ আর তক্ষকের বাসা। বাদুড় আর চামচিকের আড্ডা। বহুকাল এই জায়গায় কোনও মানুষ আসেনি। কালীমন্দিরের লাগোয়া পুকুরটাও সংস্কারের অভাবে হেজেমজে গিয়েছিল। তবে মাঝখানটায় এখনও গভীর জল।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে আসছে। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচিরে কান পাতা দায়। কালীমন্দিরের চাতাল দিয়ে ধীর পায়ে দুটো নেকড়ে এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে চলে গেল। বাঁশবন থেকে বেরিয়ে গোটাচারেক শেয়াল দ্রুতবেগে দৌড়ে আরএকধারের বাঁশবনে গিয়ে সেঁধোল। একপাল বুনো কুকুরের ডাক নিস্তব্ধতাকে হঠাৎ খানখান করে ভেঙে দিচ্ছিল।
মন্দিরের ভেতরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। যে বেদিটার ওপর এককালে বিগ্রহ ছিল, তার ওপর ধুলোময়লার মধ্যেই শুয়ে ছিল একটা লোক। পরনে একটা ময়লা প্যান্ট, গায়ে একটা ময়লা হাওয়াই শার্ট। লোকটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল। আচমকাই বেদির নীচের ফাটল থেকে একটা মস্ত গোখরো সাপ হিলহিল করে বেরিয়ে এল। তারপর ধীরগতিতে উঠে এল বেদির ওপর। সাপটা লোকটার শরীরের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল ওপাশে। ঘুমন্ত লোকটা বিরক্ত হয়ে একটা হাত তুলে সাপটাকে ঝেড়ে ফেলতে যেতেই প্রকাণ্ড সাপটা প্রকাণ্ড ফণা তুলে দাঁড়াল লোকটার বুকের ওপর। তারপর বিদ্যুৎগতিতে তার ছোবল নেমে এল লোকটার কপালে।
বাঁ হাত দিয়ে সাপের গলাটা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই ধরল লোকটা। তারপর উঠে বসে একটা হাই তুলল। সাপটা কিলবিল করছিল তার হাতের মধ্যে। সাপটাকে দু হাতে ধরে মন্দিরের বাইরে এসে লোকটা চারদিকে চেয়ে দেখল একটু। তারপর সাপটাকে ছেড়ে দিল সামনে। তারপর আবার একটা হাই তুলল।
এই জঙ্গলের ভয়াবহতম প্রাণী হচ্ছে বুনো কুকুর। ক্ষুধার্ত হিংস্র বুনো কুকুরকে বাঘও ভয় খায়। কারণ তারা একসঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটটা করে ঘুরে বেড়ায়, সামনে যে-কোনও প্রাণীকে পেলে সবাই মিলে আক্রমণ করে কয়েক মিনিটের মধ্যে খেয়ে সাফ করে দেয়।
লোকটা বাইরে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বুনন কুকুরদের চিৎকার শুনছিল। কুকুরের পাল এগিয়ে আসছে এদিকেই। লোকটার তাতে কোনও উদ্বেগ বা ভয় দেখা গেল না। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীর পায়ে জঙ্গল ভেঙে এগোতে লাগল। তার শরীরের ধাক্কায় বাঁশঝোঁপের দু-একটা বাঁশ মচকে গেল, ছোটখাটো গাছ কাত হয়ে পড়তে লাগল।
হঠাৎ ঝোঁপঝাড় ভেঙে একপাল বুনন কুকুর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। সে তেমন ঘাবড়াল না। দুটো কুকুরকে তুলে অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল! আর বাকিগুলোকে পা দিয়ে কয়েকটা লাথি কষাল। আশ্চর্যের বিষয়, ভয়ঙ্কর বুনো কুকুরেরা কেন যেন কিছু টের পেয়ে থমকে গেল। তারপর লোকটাকে ছেড়ে দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল সকলে।
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গাঁয়ের রাস্তায় পা দেওয়ার আগে লোকটা একটা বাঁশঝোঁপের পেছনে দাঁড়িয়ে চারদিকটা ভাল করে লক্ষ করল। সে লক্ষ করল গাঁয়ের এইদিকটা আজ অস্বাভাবিকভাবে জনশূন্য। সে একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এল। ধীর এবং নিশ্চিন্ত পায়ে সে হাঁটছে। চারদিকে একটু দেখে নিচ্ছে মাঝে-মাঝে। না, তাকে কেউ লক্ষ করছে না। গাঁয়ের কুকুররা তাকে দেখে তেড়ে এলেও কাছাকাছি এসেই কেন যেন ভয় পেয়ে কেঁউ-কেঁউ করে পালিয়ে যায়।
পুবপাড়া ছাড়িয়ে কেটপাড়া। আজ সব পাড়াই জনশূন্য। রাস্তা ফাঁকা। দূরে কোথাও একটা কোলাহল শোনা যাচ্ছে। কোলাহলটা কোথা থেকে আসছে এবং কেন, তা লোকটা জানে। আজ গাঁয়ের লোক অঘোর সেনের ল্যাবরেটরি পাহারা দিতে জড়ো হয়েছে। লোকটা একটু হাসল। ওদের কাছে লাঠিসোটা আছে সে জানে।
কেওটপাড়া পার হয়ে লোকটা রাস্তা ছেড়ে আঘাটায় নেমে গেল। সামনে বনবাদাড়, ঝিল, বাঁশঝোঁপ, জলাজমি। কাঁটাঝোঁপের জঙ্গল পেরিয়ে লোকটা ঝিলের জলে অম্লানবদনে নেমে গেল। ঝিলটা সাঁতরে পার হয়ে সে বাঁশঝাড়ে ঢুকে গেল। সামনে একটা জলাজমি, তার পরেই অঘোর সেনের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়ির চারদিকে লণ্ঠন, মশাল এবং টর্চ নিয়ে বহু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তারা হল্লা করছে।
লোকটা কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বাঁশঝোঁপ থেকে বেরিয়ে জলাজমিতে পা রাখল। জলায় কোমর অবধি কাদা। একবার পড়লে আর ওঠা যায় না। কিন্তু লোকটার শরীরের শক্তি যন্ত্রের মতো। সে কাদায় নেমে সেই কাদা ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগল। কোনও অসুবিধেই হল না তার।