সুবুদ্ধি মিলিটারিতে চাকরি করত। চাকরি করতে করতে বেশ কিছু টাকা জমে গিয়েছিল হাতে। মিলিটারিতে খাইখরচ লাগে না, পোশাকআশাকও বিশেষ লাগে না, ইউনিফর্ম তো সরকারই দেয়। দিদি ছাড়া তার তিনকুলে কেউ নেই বলে কাউকে টাকাও পাঠাতে হত না। ফলে সুবুদ্ধির হাতে বেশ কিছু টাকা জমে গেল। মিলিটারিতে রিটায়ার করিয়ে দেয় খুব তাড়াতাড়ি। রিটায়ার হয়ে সুবুদ্ধি ভাবল, এবার নির্জনে কোথাও আস্তানা গেড়ে ছোটমতো একটু দোকান করবে আর একা-একা বেশ থাকবে। এই নন্দপুরের খোঁজ মিলিটারিরই একটা লোক দিয়েছিল। বলেছিল, “হুঁগলি জেলায় ওরকম জায়গা আর পাবে না। জলবায়ু যেমন ভাল, তেমনই গাছপালা আছে, নদী আছে। ব্যবসা করতে চাও তো নন্দপুর হচ্ছে সবচেয়ে ভাল জায়গা। বড় গঞ্জ, মেলা লোকজনের যাতায়াত। নন্দপুরের বাজারের খুব নাম।”
তা নন্দপুর জায়গাটা খারাপ লাগেনি সুবুদ্ধির। বাস্তবিকই জায়গাটা চমৎকার। গাঁ বলতে যা বোঝায় তাও নয়। আধা শহর, আধা গ্রাম। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চাইলেও বাধা নেই।
সুবুদ্ধির দিদি বসুমতীর শ্বশুরবাড়িও কাছাকাছিই, বৈঁচিতে। ঘণ্টাটাকের পথ। দিদি নন্দপুরের নাম শুনে বলল, “ওখানে একটা ভাল ইস্কুল আছে শুনেছি। কার্তিকটার তো এখানে লেখাপড়া তেমন ভাল হচ্ছে না। সারাদিন খেলে বেড়ায়। ওকে বরং ওখানেই তোর কাছে নিয়ে রাখ। তোরও একা লাগবে না, আর ওর ওপরেও নজর রাখতে পারবি।”
দিদির পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে। কাজেই কার্তিককে ছেড়ে দিতে জামাইবাবুরও আপত্তি হল না।
কয়েকদিন হল মামা-ভাগ্নে নন্দপুরে এসে বাজারের কাছে। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। বাড়িটাও কেনা হয়ে গেল। এখন একটু মেরামত করে নিলেই হয়। যে-ঘরটায় তারা আছে সেখানেই দোকান করা যাবে। কিসের দোকান তা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। কার্তিকের ইচ্ছে, একটা রেস্টুরেন্ট বা মিষ্টির দোকান
খোলা হোক, সুবুদ্ধির ইচ্ছে মনোহারি বা মুদির দোকান।
নন্দপুরের নামকরা মিস্তিরি হল হরেন মিস্তিরি। একডাকে সবাই চেনে। বড্ড ব্যস্ত মানুষ। তাকে ধরাই মুশকিল। দু’দিন ঘোরাঘুরির পর তিনদিনের দিন বিকেলে বাজারের পেছন দিকে হরেন মিস্তিরির বাড়িতে তাকে পাওয়া গেল। পাকানো চেহারা, মস্ত গোঁফ, মুখোনা থম-ধরা। সব শুনে-টুনে জিজ্ঞেস করল, “কোন বাড়িটা কিনলেন?”
“ওই যে পাঠকপাড়ায় নরহরিবাবুর বাড়ি।”
শুনে ফিচিক করে একটু হাসল হরেন, “কেনা হয়ে গেছে?”
“আজ্ঞে।”
“ভাল, ভাল।”
ভাল, ভাল-টা এমনভাবে বলল যে, মোটেই সেটা ভাল শোনাল না সুবুদ্ধির কানে। বলল, “কেন, কোনও গোলমাল আছে নাকি?”
“থাকুন, বুঝবেন।”
একথাটাও রহস্যে ভরা। সুবুদ্ধি বলল, “একটু খোলসা করেই বলে ফেলুন না। আমি বাইরের মানুষ, সব জেনে রাখা ভাল।”
হরেন একটা শ্বাস ফেলে বলল, “জানবেন, জানবেন, তার জন্য তাড়া কিসের? থাকতেই তো এসেছেন, থাকতে-থাকতেই জানতে পারবেন।”
সুবুদ্ধির মনে একটা খিচ ধরে গেল। হরেন মিস্তিরি কি কোনও গুহ্য কথা জানে? সে বলল, “বাড়িটা একটু পুরনো।”
হরেন গলা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “পুরনো বললে কিছুই বলা হয় না। ওবাড়ি একেবারে ঝুরঝুরে। তা কত নিল?”
“এক লাখ।”
“আপনার অনেক টাকা, না? টাকা চুলকোচ্ছিল বুঝি?” সুবুদ্ধি শুকনো মুখে ঢোক গিলে বলল, “ঠকে গেছি নাকি?”
“এখন আর সেটা জেনে লাভ কী? কিনে তো ফেলেইছেন।”
“যে আজ্ঞে।”
হরেন মিস্তিরি বলল, “ঠিক আছে, কাল আমি লোকজন নিয়ে যাব। তবে বলেই রাখছি মশাই, ওবাড়ি মেরামত করতে বেশ খরচ হবে আপনার।”
সুবুদ্ধি দমে গিয়ে বলল, “তা কত পড়বে?”
“আগে দেখি, তারপর হিসেব।”
নন্দপুরে এসে জায়গাটা দেখে বেশ আনন্দ হয়েছিল সুবুদ্ধির। কিন্তু আনন্দটা এখন ধীরে-ধীরে কমে যাচ্ছে। একটু উদ্বেগ হচ্ছে।
পরদিন হরেন মিস্তিরি বাড়ি মেরামত করতে গেলে একটা বিপত্তি ঘটল। হরেনের এক শাগরেদ পাঁচু কোণের ঘরের ফাটা মেঝেতে একটা আলগা চাঙড় তুলতে যেতেই মেঝে ধসে সে পাঁচ হাত গর্তের মধ্যে পড়ে গেল। হাঁটু ভাঙল, মাজায় চোট।
হরেন মিস্তিরি মাথা নেড়ে বলল, “শুরুতেই এমন অলক্ষুণে কাণ্ড মশাই, আমি এ-বাড়ি মেরামত করতে পারব না। পাঁচুই আমার বল-ভরসা। সে বসে যাওয়াতে আমার ভারী ক্ষতি হল। আর ছোঁড়াটাও বোকা। কতবার শিখিয়ে-পড়িয়ে দিলাম, ওরে ওদিকপানে তাকাসনে, তা হলেই বিপদ। তা ছোঁড়া শুনল সে কথা? ঠিক তাকাল, আর পড়লও বিপদে।”
সুবুদ্ধি শুকনো মুখে বলল, “কোনদিকে তাকানোর কথা বলছেন?”
হরেন নরহরিবাবুর মতোই কটমট করে তাকিয়ে বলল, “সে আমি বলতে পারব না মশাই, নিজেই বুঝবেন।”
হরেন মিস্তিরি দলবল নিয়ে চলে যাওয়ার পর সুবুদ্ধি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, “এখন কী হবে রে কার্তিক?”
কার্তিক বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে বলল, “দেখো মামা, আমি বলি কি, মেরামতের দরকার নেই। একটু ঝটপাট দিয়ে চলো দুটো চৌকি কিনে এনে এমনিই থাকতে শুরু করি। তারপর দুজনে মিলে রংটং করে নেব’খন ধীরেসুস্থে।”
“বলছিস?” “বাড়িখানা আমার দিব্যি পছন্দ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে আজ থেকেই থাকি।”
তা বাড়িটা সুবুদ্ধিরও কিছু খারাপ লাগছে না। পুরনো আমলের ত্রিশ ইঞ্চি মোটা দেওয়াল, পোক্ত গঠন। তিনখানা ঘর, একখানা দরদালান আছে। পেছনে একটু বাগান, তাতে অবশ্য আগাছাই বেশি। সুবুদ্ধি আর কার্তিক বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখল। তিন নম্বর ঘরটা ভেতর দিকে। বেশ বড় ঘর, তারই মেঝেটা এক জায়গায় বসে গেছে।