ভূতনাথবাবু বললেন, “আমি নিজেই একজন সায়েন্টিস্ট। আমি জানি, ঘটনাটা প্রায় অলৌকিক। অঘোর সেন আইনস্টাইনের চেয়ে কম নন।”
সনাতন বলে উঠল, “ইঞ্জিরি বলছ নাকি খোকা? ওইসব ভাষা যে আমি বুঝি না।”
ভূতনাথ বললেন, “আপনার বোঝার কথাও নয়। আইনস্টাইন আপনার অনেক পরে জন্মেছেন। কিন্তু কথা হল, আমাদের সামনে এখন কঠিন বিপদ। লোকটা কাল আমাকে আর আমার সহচরটিকে প্রায় যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। ঘরে-ঘরে গর্ত খুঁড়ে দেখেছে কোথাও পাতালঘর আছে কি না। এর পর সে দ্বিজপদকেও মেরে তাড়ায়। শুনলাম সে মধ্যরাতে সুবুদ্ধি রায়কেও নাকি মেরে একটা গর্তে ফেলে দেয়।”
সুবুদ্ধি বিনয়ের সঙ্গে বলল, “সে কাজটা উনি ভালই করেছেন। গর্তে আমাকে ফেলে দিয়েছিলেন বলেই অঘোর সেনের ল্যাবরেটরি আর সনাতনবাবুর হদিসটা পাওয়া গেল। কিন্তু লোকটা কে বলুন তো! বাংলায় কথা বলছিল বটে কিন্তু বাঙালি বলে মোটেই মনে হল না। আর গায়ে কী সাঙ্ঘাতিক জোর। আমাকে যেন পুতুলের মতো তুলে সপাং করে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এরকম পালোয়ান লোক আমি জন্মে দেখিনি।”
ভূতনাথ চিন্তিতভাবে বললেন, “সেইটেই ভয়ের কারণ। লোকটা কে বা কোত্থেকে এল তা আমরা জানি না। কিন্তু সে যে সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক লোক, তাতে সন্দেহ নেই। যাকগে, ওটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত আপনাদের আপত্তি না থাকলে
ল্যাবরেটরিটা আমি একটু দেখতে চাই।”
“আসুন, আসুন,” বলে সুবুদ্ধি খাতির করে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল সবাইকে।
একটু কষ্ট করেই একে-একে ল্যাবরেটরিতে নামলেন ভূতনাথ সুবুদ্ধি আর সমাজ মিত্তির। আর কাউকে যেতে দিলেন না ভূতনাথ। প্রদীপটা এখনও জ্বলছে। ঘরভরা উজ্জ্বল আলো।
প্রথমে প্রদীপটাই একটু পরীক্ষা করলেন ভূতনাথ। মাথা নেড়ে বলেন, “এরকম কখনও দেখিনি। আমাদের বিজ্ঞান এ-জিনিস এখনও কল্পনা করতে পারেনি।”
টেবিলের ওপর যে দুটো বন্ধ বাক্স রয়েছে, খুব সাবধানে একে একে সে-দুটোও খুললেন ভূতনাথ। ভেতরে ঝকঝকে কিছু অদ্ভুতদর্শন জিনিস এবং যন্ত্র রয়েছে। ভূতনাথ অনেকক্ষণ ধরে টর্চ জ্বেলে ভেতরটা দেখে নিয়ে ফের মাথা নেড়ে বলেন, “এসব যন্ত্রপাতি দেড়শো বছর আগে কেউ কল্পনা করেছিল, ভাবাই যায় না! এসব তো আজকের দিনেও আমরা কল্পনাই করি মাত্র। অঘোর সেন কী ধরনের মানুষ ছিলেন বুঝতে পারছি না। এসব সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরিই বা করলেন কী করে। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার।”
সুবুদ্ধি বলল, “সনাতনবাবু বলছিলেন, হিকসাহেব বলে কে একজন অঘোরবাবুর কাছে আসত। সে নাকি মানুষ নয়, ভূত। অঘোরবাবু ওই বাক্সটার গায়ে সাঁটা কাগজটাতেও হিক সাহেবের কথা লিখেছেন।”
ভূতনাথবাবু লেখাটা দেখে বললেন, “হুঁ। অঘোর সেনের আমলে যে এসব সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতি পৃথিবীতে তৈরি হত না সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু হিসাহেবটা কে, তা বুঝতে পারছি না। হিক নামে কোনও বড় বৈজ্ঞানিকের নাম তো শুনিনি!”
সুবুদ্ধি বলল, “সনাতনবাবু বলেন, হিক আকাশ থেকে কৌটো করে নেমে আসত। আর তখন নন্দপুরে বিনা মেঘেও বিদ্যুৎ চমকাত।”
ভূতনাথ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “আকাশ থেকে! কৌটো করে! এসব তো আষাঢ়ে গল্প।”
সনাতনবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস হিসাহেব ভূত ছাড়া কিছু নয়।
ভূতনাথবাবু বললেন, “ভূত বলে কিছু নেই। তবু হিক যদি ভূতই হয় তা হলেও বাঁচোয়া! কিন্তু ভূত না হলে চিন্তার কথা। চলুন সমাজবাবু, ওপর যাওয়া যাক। ল্যাবরেটরিটা এক অমূল্য সম্পদ। একে রক্ষা করার জন্য ভাল ব্যবস্থা করতে হবে। আবার পাঁচকান করা চলবে না। তা হলে গুচ্ছের লোক এসে ভিড় করবে। বাছা বাছা লোকজন নিয়ে পাহারা বসানো দরকার। নইলে ওই হামলাবাজটা এসে আবার ঝামেলা পাকাতে পারে।”
“যে আজ্ঞে, যথার্থই বলেছেন। লোকটা ঝামেলা পাকাবেই। আমাকে গর্তের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে লোকটা যখন পালিয়ে যায় তখন আমার ভাগ্নে কার্তিক বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটাকে দেখে সে একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। সে নিজের কানে। শুনেছে লোকটা চাপা গলায় অদ্ভুত ভাষায় কী যেন বলছিল। ভাষাটা সে বুঝতে পারেনি। তবে দেখেছে, লোকটা চকের মতো একটা জিনিস দিয়ে আমাদের বাইরের দেওয়ালে একটা ঢ্যাঁড়া কেটে দিয়ে চলে যায়। সেই ঢ্যাঁড়ার দাগটা নাকি অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল।”
“বলেন কী?” ভূতনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, “এতক্ষণ বলেননি কেন?”
“আজ্ঞে। একসঙ্গে অনেক ঘটনার ধকল সামলাতে হচ্ছে তো! কোনটা আগে বলব, কোনটা পরে, তার তাল রাখতে পারছি না।”
“চলুন তো দাগটা দেখি।” মাথা নেড়ে সুবুদ্ধি বলল, “আমি দেখেছি, কোনও দাগ নেই। মনে হচ্ছে ওটা এমন একটা জিনিস, যা রাত্রে জ্বলজ্বল করে, কিন্তু দিনের আলোয় অদৃশ্য হয়ে যায়।”
ভূতনাথ গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, এরকম জিনিস থাকতেই পারে। তার মানে বাড়িটা দেগে রেখে গেছে। তার মানেই হচ্ছে লোকটা রাতের দিকেই আসবে। আর তার মানে হচ্ছে, লোকটা বুঝতে পেরেছে যে, এটাই অঘোর সেনের বাড়ি।”
সুবুদ্ধি একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, তার মানে হচ্ছে আমাদের সামনে এখন অঘোর বিপদ। অঘোরবাবু এতসব কাণ্ড ফাণ্ড না করলে আজ এত নাকাল হতে হত না।”
ভূতনাথবাবু করুণ অসহায় গলায় সমাজবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “এ-গাঁয়ে ব্যায়ামবীর-টির নেই? কিংবা ক্যারাটে, কুংফু জানা লোক?”