“আজ্ঞে, ওসব ঠিকই আছে।”
“ঠিক আছে কী রে? পৌনে দুশো বছরে যে লোহা অবধি ক্ষয় হয়ে যায়। দাঁড়া বাপু দাঁড়া, ভাল করে হেঁটেচলে দেখি পায়ের জোড়গুলো ঠিক আছে কি না।”
“আজ্ঞে আছে। এতক্ষণ হাঁটাচলাই করছিলেন। দিব্যি পাতালঘর থেকে ওপরে উঠে এলেন।”
হঠাৎ সনাতন কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, “হ্যাঁ রে, আমার নিত্যানন্দ আর সত্যানন্দ। তারা বেঁচে নেই?”
“দুঃখ করবেন না বিশ্বাসমশাই। তাঁরা সব পাকা বয়সেই গেছেন। শুনলেন তো, নিত্যানন্দের সাত ছেলে ছিল।”
“নিত্যানন্দকে যে মাত্র ছ’ বছরের রেখে আমি কালঘুম ঘুমোতে এলাম। কত বয়স হয়েছিল তার বল তো?”
সুবুদ্ধি বানিয়ে বলল, “আজ্ঞে নব্বই বছর। দুঃখের কিছু নেই, এই তো শুনলেন আমাদের গোবিন্দ বিশ্বাসই আপনার অধস্তন কত পুরুষ যেন।”
“ওই বিচ্ছিরি ঝগড়টে লোকটা?”
“যে আজ্ঞে।” সনাতন খানিকক্ষণ গুম হয়ে থেকে হঠাৎ চনমনে হয়ে বলল, “ওরে ডাক তো খোকাটিকে। আমারই তো বংশ। ডাক তো, ভাল করে একটু মুখোনা দেখি।”
“আজ্ঞে, এই ডাকছি।” বলে বারান্দায় গিয়ে ভারী বিনীত গলায় সুবুদ্ধি ডাকল, “গোবিন্দদা! ও গোবিন্দদা। একটু বাইরে আসবেন?”
গোবিন্দ বিশ্বাস বারান্দায় এসে সুবুদ্ধির দিকে অবাক চোখে চেয়ে বললেন, “এই প্রাতঃকালটায় আমার মুখ দেখে ফেললে যে! তোমার তো বড় সাহস দেখছি হে! বিপদে পড়লে আমার দোষ দিয়ো না যেন। আমি পাড়াপ্রতিবেশীকে কখনও বিপদে ফেলতে ভালবাসি না।”
সুবুদ্ধি মাথা চুলকে হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “আজ্ঞে সেই কথাটাই বলার জন্য ডাকা আপনাকে। অপরাধ নেবেন না। অপয়া দর্শনের একটা ভাল নিদান পাওয়া গেছে। দয়া করে যদি গরিবের বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো দেন!”
“নিদান পেয়েছ! তবে তো ভয়ের কথা হল হে। নিদানটা আবার পাঁচজনকে চিনিয়ে বেড়িয়ো না। করে-কর্মে খাচ্ছি, ব্যরসা লাটে উঠবে। দাঁড়াও, চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে আসছি।”
গোবিন্দ বিশ্বাস এলেন এবং মন দিয়ে সব শুনলেন। তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল, গলা ধরে এল, গলবস্ত্র হয়ে একেবারে উপুড় হয়ে পড়লেন সনাতনের পায়ে, “এও কি সম্ভব? এই চর্মচক্ষে আপনার দেখা পাব–এ যে স্বপ্নেও ভাবিনি! আপনি হলেন আমার ঠাকুদার ঠাকুরদার ঠাকুদা… না, একটা ঠাকুদা বোধ হয় কম হল!”
সনাতন বড় আদরে গোবিন্দর মুখোনা তুলে দু হাতে ধরে নিরীক্ষণ করতে করতে গদগদ হয়ে বললেন, “তা হোকগে, একটা ঠাকুদার কম বা বেশি হলে কিছু না। আহা, এ তো দেখছি আমার নিত্যানন্দের মুখ একেবারে কেটে বসানো? নাকখানা অবশ্য সত্যানন্দের মতো। আহা, খোকাটিকে দেখে বুক জুড়িয়ে গেল। তা হ্যাঁ রে দুষ্টু, তোর বাপ বেঁচে নেই?”
চোখের জল মুছতে মুছতে গোবিন্দ বিশ্বাস বললেন, “আজ্ঞে আছেন। বিরানব্বই চলছে।”
“ডাক, ডাক তাকে। বিরানব্বই আবার একটা বয়স নাকি! দুধের শিশুই বলতে হয়।”
তা বিরানব্বই বছরের বাপও এসে সব শুনে ভেউ ভেউ করে কেঁদে সনাতনের পা জড়িয়ে ধরলেন। সনাতন তাঁকে আদরটাদর করে, গালে ঠোনা মেরে খুব চনমনে হয়ে উঠলেন। শোকটা কেটে গেল।
তারপর গোবিন্দ বিশ্বাসের দিকে চেয়ে বললেন, “তুই নাকি খুব অপয়া রে ভাই?”
গেবিন্দ বিশ্বাস তাড়াতাড়ি সনাতনের পায়ের ধুলো নিয়ে লজ্জায় মাথা নত করে বলল, “আপনার তুলনায় নস্যি। তবে অপয়া বলেই চারটি খেতে-পরতে পারছি। লোকে মানে গোনে।”
“বাঃ বাঃ। শুনে খুব খুশি হলুম। তবে মুশকিল কী জানিস? প্রাতঃকালে যদি দু-দুটো অপয়ার মুখ দেখতে পায় মানুষ, তা হলে
আর অপয়ার দোষ থাকে না। কেটে যায়।”
গোবিন্দ আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! তা হলে যে ব্যবসা লাটে উঠবে! সুবুদ্ধি বুঝি এই নিদানের কথাই বলছিল?”
সনাতন গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ। তবে তোর ব্যবসা আমি নষ্ট করব না। ঘর-সংসার যখন নেই তখন আর এখানে থেকে হবেটা কী? ভাবছি, হিমালয়ে গিয়ে সাধু হয়ে যাব।”
“আজ্ঞে তাই কি হয়?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন সমাজ মিত্তির আর ভূতনাথ নন্দী। তাঁদের একটু পেছনে বটকেষ্ট আর দ্বিজপদ। সুবুদ্ধি শশব্যস্তে তাদের বসবার জায়গা করে দিল।
সমাজ মিত্তির সনাতনের পায়ের ধুলো নিয়ে বললেন, “ঘটনাটা এই মাত্র সেদিন এক বিলিতি জানালে বেরিয়েছিল। তারাও খুব একটা বিশ্বাস করেনি। তারা কেবল তাদের পুরনো জানাল থেকে রিপ্রিন্ট করেছিল খবরটা। তাতেই আমি জেনেছিলুম যে, পাগলা বৈজ্ঞানিক অঘোর সেন কী একটা পদ্ধতি জানতেন যাতে মানুষকে অবিকৃত অবস্থায় বহু বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়। এবং সে বাবদে একটা এক্সপেরিমেন্টও নাকি করে গেছেন। কিন্তু এক্সপেরিমেন্টটা কোথায় করেছিলেন তার হদিস জানালটায় দিতে পারেনি। শুধু লেখা ছিল, নন্দপুর গাঁয়েই একটা লোককে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। লোকটার নাম সনাতন বিশ্বাস। কিন্তু অঘোরবাবু বিয়ে করেননি, তাঁর বংশধর বলেও কেউ নেই। ফলে মৃত্যুর পরই তাঁর বাড়িতে অন্য সব লোক বসবাস শুরু করে। তবে জানালে প্রবন্ধটা বেরনোর পর আমার মতো দু-চারজন খোঁজখবর শুরু করেছিল। এই যে ভূতনাথ নন্দী, ইনিও তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি অবশ্য বুদ্ধি করে অঘোর সেনের নাম উহ্য রেখে এ-গাঁয়ের পুরনো ভূতের বাড়ি খুঁজতে থাকেন। তিনি অবশ্য একটা বাড়ি অনুমানে ভর করে কিনেও ফেললেন। কিন্তু সেই বাড়ি অঘোর সেনের নয়। অঘোর সেনের বাড়িটা কিনল সুবুদ্ধি রায়। যাই হোক, গতকাল থেকে এ-গাঁয়ে একজন সাঙ্ঘাতিক লোকের উদয় হয়েছে, যে অঘোর সেনের বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোনওরকম বাধা দিলেও সে মেরে বসছে লোককে। বাধা না দিলেও সন্দেহের বশে মারছে। আমাদের সন্দেহ, লোকটা অঘোর সেনের ল্যাবরেটরি আর সনাতন বিশ্বাসের সন্ধান করে মস্ত দাঁও মারার চেষ্টায় আছে। দেড়শো বছর আগেকার ল্যাবরেটরিতে কী কাণ্ড করেছিলেন অঘোর সেন, তা জানলে দুনিয়া তাজ্জব হয়ে যাবে। আর সনাতনবাবুকে তো ছিঁড়ে খাবে দুনিয়ার বৈজ্ঞানিকরা। কাজেই এখন সনাতনবাবু এবং অঘোর সেনের ল্যাবরেটরি হামলাবাজদের হাত থেকে বাঁচানোটাই আমাদের প্রধান কাজ।”