বলে সনাতনকে একরকম টেনেহিঁচড়েই ঘরে নিয়ে গেল সুবুদ্ধি।
গোবিন্দ বিশ্বাস একটু হেঁকে বললেন, “যতই তর্ক করো বাপু, আজ ঠেলাটি বুঝবে। প্রাতঃকালেই আজ এই শর্মার মুখোনা দেখেছ, যাবে কোথায়? বলে কিনা উনিই সনাতন বিশ্বাস। সনাতন বিশ্বাস হওয়া কি মুখের কথা? অনেক জন্ম তপস্যা করে তবে সনাতন বিশ্বাস হতে হয়। তাঁর মতো অপয়া ভূ-ভারতে ছিল না। আর অত নামডাক হচ্ছিল বলেই তো তাঁকে গুমখুন করে ফেলা হয়। লাশটার অবধি হদিস কেউ পায়নি। আর ইনি কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে বুক বাজিয়ে বলছেন, আমিই সনাতন বিশ্বাস। উঁঃ।”
ঘরের মধ্যে তখন সনাতন বিশ্বাস চোখ গোলগোল করে গোবিন্দর চেঁচামেচি শুনতে-শুনতে সুবুদ্ধিকে বলল, “কী বলছে বল তো লোকটা?”
“আজ্ঞে, ওদিকে কান না দেওয়াই ভাল। আর আপনিও বড্ড ভুল করে বসেছেন। প্রাতঃকালে ওঁর মুখোনা না দেখলেই ভাল করতেন। উনি ঘোর অপয়া লোক। ভুলটা আমারই। আপনাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিল। যাকগে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আজ একটু সাবধানে থাকবেন।”
সনাতন একটু আত্মবিশ্বাসের হাসি হেসে বলল, “আমাকে অপয়া দেখাচ্ছিস! শুনলেও হাসি পায়। ওরে, আমি এমন অপয়া লোক যে, প্রাতঃকালে আমার মা অবধি আমার মুখ দেখত না। আমি রাস্তায় বেরোলে কুকুর-বেড়াল অবধি পাড়া ছেড়ে পালাত।”
“অ্যাঁ,” বলে সুবুদ্ধি এমন হাঁ করল যে, তাতে চড়াইপাখি ঢুকে যেতে পারে। তারপর ঢোক গিলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “তা হলে কী হবে! আমি যে প্রাতঃকাল থেকে আপনার মুখ দেখছি।”
সনাতন ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তা অবশ্য ঠিক। তবে তোকে একটা গুপ্ত কথা বলতে পারি। খবরদার আর কাউকে বলবি না তো?”
“আজ্ঞে না।”
“পাশের বাড়ির লোকটা কীরকম অপয়া বল তো!”
“আজ্ঞে সাঙ্ঘাতিক।”
“দূর দূর! তেমন অপয়া হলে পাড়ায় কুকুর-বেড়ালও থাকত না। আমি তো দেখলুম, ওর বারান্দার সিঁড়িতে দিব্যি গ্যাঁট হয়ে একটি বেড়াল বসে আছে। তা যাকগে, কমজোরি অপয়া হলেও চলবে। তুই যদি সকালে দু-দুটো অপয়ার মুখ দেখে ফেলিস, তা হলে আর ভয় নেই। একটার দোষ আর-একটায় কেটে যাবে।”
“বটে!”
“খবরদার, পাঁচ কান করিস না।”
“আজ্ঞে না।”
“তা হলে আমি এবার বাড়ি চললুম। গিয়ে গোরুগুলোকে মাঠে ছাড়তে যেতে হবে, গেরস্থালির আরও কত কাজ পড়ে আছে। অঘোরবাবুকে পেলে টাকাটা আদায় করে নিয়ে যেতুম। কিন্তু আর দেরি করার জো নেই।”
সুবুদ্ধি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “যে আজ্ঞে, বাড়ি যাবেন সে আর বেশি কথা কী? তবে একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে কিনা, তাই বলছিলুম–”
“গণ্ডগোল! কিসের গণ্ডগোল?”
“আজ্ঞে, আপনার ঘুমটা একটু বেশি লম্বা হয়ে গেছে কিনা, তাই”
“অ্যাাঁ! খুব লম্বা ঘুম ঘুমিয়েছি নাকি? তা সেটা কত লম্বা? দু’দিন, তিনদিন নাকি রে?”
“আজ্ঞে না। আর একটু উঠন।”
“ওরে বাবা! দু-তিনদিনেরও বেশি? তবে কি দিনপাঁচেক?”
“আরও একটু উঠুন।”
“আরও? ও বাবা, আমার যে মাথা ঘুরছে।”
“তা হলে একটু শক্ত হয়ে বসুন। তারপর একটু চিড়ে দুই ফলার করে নিন। তাতে গায়ে একটু বল হবে। মনটাকে বেশ হালকা করে রাখুন। “
সনাতন দই-চিঁড়ে খেল। তারপর বিছানায় বেশ জুত করে বসল, “এবার বল তো বৃত্তান্তটা কী।”
“আজ্ঞে আপনি টানা দেড়শো বছর ঘুমিয়ে ছিলেন।”
সনাতন সোজা হয়ে বসে বলল, “দেড় বছর! বলিস কী রে ডাকাত! দেড় বছর কেউ ঘুমোয়? তুইও দেখছি নেশাখোর!”
“দেড় বছর হলে তো কথাই ছিল না মশাই। দেড় বছর নয়। দেড়শো বছর।”
সনাতন এবার এমন হাঁ হল যে, তাতে একটা ছোটখাটো বেড়াল ঢুকে যায়। তারপর খানিকক্ষণ খাবি খেয়ে বলল, “তুই খুব নেশা করিস।”
“আজ্ঞে না। ভাল করে যদি চেয়ে দেখেন চারদিকটায় তা হলেই বুঝতে পারবেন। কিছু কি আর আগের মতো আছে। দেখছেন? অত বড় আমবাগান আর বাঁশবাগান কোথায় গেল?”
সনাতন ঢোক গিলে বলল, “একটু-একটু মনে পড়ছে সব। অঘোরবাবুর বাড়ির উলটো দিকে একটা মস্ত ঝিল ছিল। সেটাও তো দেখছি না।”
“আজ্ঞে, দেড়শো বছর লম্বা সময়।”
“তা হলে আমার বাড়ি! আমার বাপ-মা ছেলেপুলে সব? তাদের কী হল?”
“আজ্ঞে, দেড়শো বছরে কি কিছু থাকে? তবে পুত্রপৌত্রাদি এবং তস্য তস্য পুত্রপৌত্রাদি নিশ্চয়ই আছে।”
“তার মানে কেউ বেঁচে নেই বলছিস নাকি?”
“বেঁচে থাকলে কি ভাল হত মশাই? তবে সবাই বেশ দীর্ঘজীবী হয়েই সাধনোচিত ধামে গমন করেছেন।”
“এ-হো-হো…!” বলে সনাতন ডুকরে কেঁদে উঠল। সেই বুক-ফাটা কান্নায় সুবুদ্ধিরও চোখে জল এসে গেল। সে তাড়াতাড়ি সনাতনের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “অত উতলা হবেন না। বয়সটার কথাও একটু বিবেচনা করুন। এই পৌনে দুশো বছর বয়সে অত উতলা হলে ধকল সামলানো যে মুশকিল হবে।”
সনাতন হঠাৎ কান্না থামিয়ে সচকিত হয়ে বলল, “কত বললি?”
“আজ্ঞে হিসেবমতো পৌনে দুশো বছরেরও একটু বেশি।”
“উরে বাবা রে! তা হলে তো বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি! সর্বনাশ! এত বুড়ো নাকি রে আমি? হিসেবে কিছু ভুল হয়নি তো রে?”
“আজ্ঞে না। দু-চার বছর এদিক-ওদিক হতে পারে।”
“একটু কম করে ধরলে হয় না রে?”
“চাইলে করতে পারেন। আসলে আপনি তো আটকে আছেন সেই আঠাশেই।”
“আঠাশ! এই যে বলছিস পৌনে দুশো!”
“দুটোই ঠিক। একদিক দিয়ে দেখলে আঠাশ, অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে পৌনে দুশো।”
“ওরে বাপ রে? তা হলে আমি বুড়ো হতে-হতে জরদগব হয়ে পড়েছি। হাঁটাচলা করতে পারব কি? চোখে ছানি হয়নি তো! হ্যাঁ রে দাঁতগুলো সব গেছে নাকি? আরও কী কী হল দেখ তো ভাল করে।”