লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “ভাল মনে পড়ছে না। আমিও ব্যাপটা ঠিক চিনতে পারছি না। এ বাড়িটা অঘোর সেনের তা জানি, কিন্তু বাদবাকি সব রাতারাতি পাল্টে গেছে দেখছি!”
“অঘোর সেন! আ মলো, অঘোর সেনটা আবার কে?”
“অঘোর সেনকে চেনেন না? আর বলছেন দ্বাদশ পুরুষের বাস!”
লোকটা পাগলটাগল হবে। আর না-ঘাঁটানোই ভাল, বিবেচনা করে গোবিন্দ বিশ্বাস বললেন, “তা সুবুদ্ধি ভায়াকে দেখছি না যে!
সে কোথায় গেল?”
“সে কুয়োর পারে হাত-পা ধুচ্ছে আর তার ভাগ্নে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু আমি ভাবছি এ কি দৈত্যদানোর কাণ্ড নাকি? এত সব বাড়িঘর রাস্তাঘাট কোথা থেকে হল? কবে হল?”
গোবিন্দ বিশ্বাস একটু হেসে বললেন, “জন্মাবধিই দেখে আসছি। নতুন তো হয়নি। তা ভায়া কি এতদিন বিলেতে ছিলেন?”
“বিলেত! বিলেতে থাকব কেন মশাই? ম্লেচ্ছ দেশ, সেখানে গেলে একঘরে হতে হবে না?”
“হাসালে ভায়া। আজকাল আর ওসব কে মানে বলো তো! আকছার লোকে যাচ্ছে। ওসব হত সেই আগের দিনে।”
সনাতন কেমন ক্যাবলার মতো চেয়ে থেকে বলল, “আচ্ছা মশাই, অঘোর সেনের বাড়ির এ পাশটায় তো একটা আমবাগান ছিল, আর বাঁশবন। তা আপনার এই বাড়িখানা কী করে রাতারাতি এখানে গজিয়ে উঠল?”
“তোমার মাথায় একটু পোকা আছে ভায়া। রাতারাতি গজিয়ে উঠবে কেন? পুবপাড়ায় বাপ-পিতেমোর আমলের বাড়ি ছেড়ে এখানে বাড়ি করে চলে এসেছি সেও আজ পঁচিশ বছর।”
সনাতন মাথায় হাত দিয়ে বলল, “উঃ, কী যে সব শুনছি তার দেখছি আর ঠিক-ঠিকানাই নেই। পুবপাড়ায় তো আমারও বাস। আপনাকে তো জন্মে দেখিনি মশাই!”
গোবিন্দ বিশ্বাস বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, “আগেই সন্দেহ করেছিলুম, ভায়ার মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে। পূর্বপাড়ায় যাকে জিজ্ঞেস করবে সেই দেখিয়ে দেবে বিশ্বাসবাড়িটা কোথায়। এ-তল্লাটে আমাকে চেনে না এমন লোক পাবে না।”
“বিশ্বাসবাড়ি! মশাই, মাথার গণ্ডগোল আমার না আপনার? পুবপাড়ায় তো বিশ্বাসবাড়ি একটাই। আর সেই বাড়িই যে আমার। ঊর্ধ্বতন সপ্ত পুরুষের বাস মশাই। পিতা শ্রীহরকালী বিশ্বাস, পিতামহ স্বৰ্গত জগদীশচন্দ্র বিশ্বাস। সবাই চেনে কিনা। আপনি হুট করে বিশ্বাসবাড়িটা নিজের বলে গলা তুললেই তো হবে না!”
“হাসালে ভায়া। বেশ মজার লোক তুমি হে। হোঃ হোঃ
হোঃ…”
“কেন, এতে হাসার কী আছে? সহজ সরল ব্যাপার।”
“নাঃ, স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, তুমি বড় রসিক মানুষ। পুবপাড়ার বিশ্বাসবাড়িটাও যে তোমার বাড়ি, জেনে বড্ড খুশি হলুম।”
সনাতন একটু ভ্যাবলা হয়ে বলল, “এ তো বড় মুশকিল দেখছি! সেই বাড়িতে জন্ম হল, এইটুকু থেকে এতবড়টি হলুম, আর আপনি বলছেন রসিকতা? হাতে পাঁজি মঙ্গলবার, অত একরারে কাজ কী? গিয়েই দেখাচ্ছি। এখনই শরীরটা একটু টালমাটাল করছিল বলে জিরিয়ে নিচ্ছিলুম একটু, নইলে অঘোর সেনের বাড়িতে বসে আছি কি সাধে?”
“অঘোর সেনের বাড়ি? হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ… বাপু হে, শরীর তোমার টালমাটাল করছে কি সাধে? এই বয়সেই নেশাভাঙ ধরে ফেলেছ বুঝি? এই বুড়ো মানুষটার কথা যদি শোনো তবে বলি ও-পথে আর হেঁটো না। শুনেছি নেশাভাঙ করলে পরের বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে হয়, নর্দমাকে মনে হয় শোওয়ার ঘর, বাঘকে মনে হয় বেড়াল। আর হরকালী বিশ্বাসের কথা কী বলছিলে যেন?”
“কেন, তিনি আমার পিতাঠাকুর।”
“হাঃ হাঃ হাঃ …হোঃ হোঃ হোঃ …হরকালী বিশ্বাস যদি তোমার পিতাই হন, তা হলে তোমার বয়সটা কত দাঁড়ায় জানো?”
“কেন, আঠাশ বছর।”
“আঠাশ বছর! হাসতে-হাসতে পেটে যে খিল ধরিয়ে দিলে ভায়া! আঠাশের আগে যে আরও একশো বা দেড়শো বছর জুড়তে হবে, সে-খেয়াল আছে? হরকালী বিশ্বাস, জগদীশচন্দ্র বিশ্বাস কবেকার লোক তা জানো? এঁরা সব আমারই নমস্য পূর্বপুরুষ। তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি নয়। সেইজন্যই তো বলি, নেশাভাঙ করলে এরকম যত গণ্ডগোল হয়।”
সনাতন বিশ্বাস দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলে উঠল,”খবরদার বলছি, নেশাভঙের কথা তুলে খোটা দেবেন না! আমি জন্মে কখনও তামাকটা অবধি খাইনি! আমাদের বংশে নেশাভাঙের চলন নেই। কেউ বলতে পারবে না যে, সনাতন বিশ্বাস কখনও সুপুরিটা অবধি খেয়েছে!”
গোবিন্দ বিশ্বাস হঠাৎ হেঁকে উঠে বললেন, “কে? কার নাম করলে? সনাতন বিশ্বাস!”
“যে আজ্ঞে। এই অধমের নামই সনাতন বিশ্বাস, পিতা হরকালী, পিতামহ জগদীশচন্দ্র বিশ্বাস। আরও শুনবেন? প্রপিতামহ তারাপ্রণব বিশ্বাস। বৃদ্ধ প্রপিতামহ অক্ষয়চন্দ্র বিশ্বাস।”
চোখ গোল করে গোবিন্দ বিশ্বাস বললেন, “এ যে আমার কুলপঞ্জি তুমি মুখস্থ বলে যাচ্ছ হে! কিন্তু এত সব তো তোমার জানার কথা নয়, সনাতন বিশ্বাস নাম বলছ? তা তিনিও আমার এক প্রাতঃস্মরণীয় পূর্বপুরুষ। তাঁর দুই ছেলে নিত্যানন্দ আর সত্যানন্দ। সত্যানন্দ সাধু হয়ে গিয়েছিলেন, নিত্যানন্দের সাত ছেলে অভয়পদ, নিরাপদ, কালীপদ, ষষ্ঠীপদ, শীতলাপদ, দুর্গাপদ আর শিবপদ। আমরা হলুম গে দুর্গাপদর বংশধারা। তাঁর ছিল পাঁচ ছেলে…”
“থামুন মশাই, থামুন। নিত্যানন্দর বয়স এখন মাত্র ছয় বছর। তার সাতটা ছেলে হয় কোত্থেকে? গাঁজা আমি খাই, না। আপনি খান?”
ঝগড়াটা যখন ঘোরালো হয়ে উঠছে, তখন সুবুদ্ধি এসে মাঝখানে পড়ল, “আহা করেন কী, করেন কী বিশ্বাসমশাই? সদ্য লম্বা ঘুম থেকে উঠেছেন, এখন কি এত ধকল সইবে? পৌনে দুশো বছর বয়সের শরীরটার কথাও তো ভাবতে হয়! আসুন, ঘরে আসুন।”