“ভূমিকম্পই বটে। দেড়শো বছরের পাল্লা তো চাট্টিখানি কথা নয়।”
সনাতন চটে বলল, “বারবার দেড়শো বছর দেড়শো বছর কী বলছিস বল তো! তুই কি পাগল নাকি রে?”
“পাগল তো ছিলুম না কতা, তবে এখন যেন একটু-একটু হতে লেগেছি। এমন অশৈলী কাণ্ড জীবনে দেখিনি কি না।”
“একটা কথা কিন্তু তোকে সটান বলে রাখছি বাপু, সেই পাঁচটি হাজার টাকা কিন্তু আমার চাই। অঘোর সেন কোথায় পিটটান দিল জানি না। তাকে না পেলে তোর কাছ থেকেই আদায় করব।”
“টাকা টাকা করে হেদিয়ে মরবেন না সনাতনবাবু। আগে তো গর্ভগৃহ থেকে বেরোন, তারপর টাকার কথা হবেখন।”
“মঙ্গলবার আমার জমির টাকা দিতে হবে, মনে থাকে যেন।”
“কত মঙ্গলবার এল আর গেল। মঙ্গলবারের অভাব কী? মেলা মঙ্গলবার পাবেন।”
সুবুদ্ধি খুব ধীরে-ধীরে মাটির চাঙড় ভাঙতে লাগল।
ধীরে-ধীরে ওপরের দিকটা উন্মুক্ত হচ্ছে। সেই গুণ্ডাটা কি ওপরে ওত পেতে আছে? থাকলেও চিন্তা নেই। সুবদ্ধির হাতে এখন শাবল। দরকার হলে শাবলের খোঁচায় ব্যাটাকে কাবু করা যাবে।
শেষ চাঙড়টা ধপাস করে ভেঙে ওপর থেকে ঝুরঝুর করে খানিক বালি আর সিমেন্টের গুঁড়ো ঝরে পড়ল। সুবুদ্ধি চোখ ঢেকে রেখেছিল। ধুলোবালি সরে যেতেই দেখতে পেল, ওপরে গর্তের মুখে ভোরের আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। সুবুদ্ধি হাত নীচের দিকে বাড়িয়ে বলল, “আসুন সনাতনবাবু।”
৪. গোবিন্দ বিশ্বাসের বাজার
গোবিন্দ বিশ্বাসের বাজার হয়ে যায় একেবারে সাতসকালে। দিনের আলো ফোটবার আগেই, যখন নন্দপুরের মানুষজন ঘুম থেকে ওঠেইনি ভাল করে। তা বাজার করার জন্য গোবিন্দ বিশ্বাসের কোনও ঝামেলাই নেই, এমনকী, তাঁকে বাজারে অবধি যেতে হয় না। সামনের বারান্দায় ঝুড়ি, ধামা, গামলা সব সাজানো থাকে পরপর। ব্যাপারিরা বাজারে যাওয়ার পথে আলু, বেগুন, পটল মুলো যখনকার যা সব ঝুড়িতে দিয়ে যায়। মাছওলারা এক-একজন এক-একদিন পালা করে মাছ দিয়ে যায় চুবড়ির মধ্যে। সপ্তাহে দুদিন গোবিন্দ বিশ্বাস মাংস খান, তা ঠিক দিনে
হরু কষাই সবচেয়ে পুরুষ্টু পাঁঠাটি কেটে রাং আর দাবনার সরেস মাংস রেখে যায়। দুধওলা গামলা ভরে দুধ দিয়ে যায়। মাসকাবারি জিনিসপত্র মাস পয়লা পৌঁছে দিয়ে যায় মুদি। গোবিন্দ বিশ্বাসের ভৃত্য মগন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব নজর রাখে, তারপর জিনিসপত্র ঘরে নিয়ে যায়। বন্দোবস্তটা বাজারের ব্যাপারিরা নিজেদের বাঁচাতেই করেছে। আগে গোবিন্দ বিশ্বাস নিজেই বাজারে যেতেন আর তাঁকে দেখতে পেলেই বাজারে হুলুস্থুলু পড়ে যেত। ব্যাপারিরা সব চোখে চাপা দিয়ে চোঁ-চাঁ দৌড়ে পালাত। নিদেন পালাতে না পারলে মুখ ঢাকা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকত। বাজার হয়ে যেত সুনসান। তো তারাই একদিন এসে হাতজোড় করে গোবিন্দ বিশ্বাসকে বলল, “আজ্ঞে, আপনার মতো মান্যগণ্য লোক কষ্ট করে বাজার করলে আমাদেরই লজ্জা। বাজারে আপনি কেন যাবেন? বাজার নিজেই হেঁটে আসবে আপনার দরজায়। দামের কথা তুলে আমাদের লজ্জায় ফেলবেন না। আপনার জন্য যে এটুকু করতে পারছি সেই আমাদের কত ভাগ্যি!”
সেই থেকে গোবিন্দ বিশ্বাস বাজারে যাওয়া ছেড়েছেন। পয়সা বাঁচছে, সময় বাঁচছে, ঝামেলা বাঁচছে। তা ছাড়া ব্যাপারিরা যা দিয়ে যায় সব বাছাই জিনিস। পচা-ঘচা, বাসি বা নিরেস জিনিস কেউ দেয় না। সকলেরই তো ভয় আছে। অপয়া হওয়ার যে কী সুখ তা তিনি আজ গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। সামনের কয়েক জন্ম এরকম অপয়া হয়েই তাঁর জন্মানোর ইচ্ছে।
আজ সকালে বেশ তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল গোবিন্দবাবুর। উঠে দাঁতন করতে করতে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন, আজ মাছের চুবড়িতে চিতল মাছের পেটি, লাফানো কই আর রুই মাছের মস্ত একটা খণ্ড পড়েছে। মেঠাইওলা রঘু আজ এক হাঁড়ি গরম রসগোল্লা রেখে গেছে। এক ডজন ডিম আর এক শিশি ঘিও নজরে পড়ল। মনটা ভারী খুশি হয়ে গেল তাঁর। ব্যাপারিদের বাড়বাড়ন্ত হোক। হিরের টুকরো সব।
ভৃত্য মগন জিনিসগুলো সব ঘরে আনার পর তিনি দাঁতন করতে করতেই একটু বারান্দায় বেরোলেন। আজকাল আর আগের মতো প্রাতভ্রমণ হয় না। অন্য যারা সব প্রাতভ্রমণ করে তারাই চাঁদা তুলে মাসের শেষে থোক কিছু টাকা দিয়ে যায়। সকলের দিকই তো দেখতে হবে, তাই প্রাতভ্রমণ বন্ধ করেছেন। বারান্দাতেই একটু হাঁটাহাঁটি করেন।
আজ হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল, পাশের বাড়ির বারান্দায় বসে একটা লোক তাঁকে খুব ড্যাব ড্যাব করে দেখছে। তিনি ভারী অবাক হলেন। নতুন লোকই হবে। নইলে এই সকালবেলায় তাঁর মুখের দিকে চাইবে এমন বুকের পাটা কার আছে!
তবে তিনি খুশিও হলেন। মাঝে-মাঝে নিজের অপয়া ব্যাপারটা এভাবেই শামিয়ে নেওয়া যায়। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি মোলায়েম গলায় বললেন, “নতুন বুঝি?”
লোকটা একটু রোগাভোগা, চেহারাটাও ফ্যাকাসে। মেজাজাটা বেশ তিরিক্ষে। খ্যাঁক করে উঠে বলল, “কে নতুন?”
“এই তোমার কথাই বলছি ভায়া। সুবুদ্ধির কেউ হও বুঝি? কবে আসা হল?”
লোকটা রেগে গিয়ে বলল, “এই গাঁয়ে আমার সাত পুরুষের বাস তা জানেন? আসা হবে কেন? এই গাঁয়েই থাকা হয়।”
গোবিন্দবাবু অবাক হয়ে বললেন, “থাকা হয়? কোন বাড়ি বলো তো! এ-গাঁয়ে আমার ঊর্ধ্বতন দ্বাদশ পুরুষের বাস।”