“যে আজ্ঞে।”
“এখন রাত কত হল বল তো?”
“তা শেষরাত্তিরই হবে মনে হয়।”
“বলিস কী? সেই সকালবেলাটায় ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াল এর মধ্যেই শেষ রাত্তির! আজব কাণ্ড। “
মাঝখানে যে দেড়শো বছর কেটে গেছে সেটা আর ভাঙল না সুবুদ্ধি।
“ওরে, আমাকে একটু ধরে তোল তো, শরীরটা জুত লাগছে না। মাথাটাও ঘুরছে। আরও একটু শুয়ে থাকতে পারলে হত, কিন্তু তার জো নেই। গোরুগুলোকে জাবনা দিয়ে মাঠে ছেড়ে আসতে হবে। তারপর গঞ্জে আজ আবার হাটবার। মেলা কাজ জমে আছে।”
“আজ্ঞে এই তুলছি।” বলে সুবুদ্ধি সনাতনকে ধরে তুলে বসাল। একটু নড়বড় করলেও সনাতন বসতে পারল। চারদিকটা প্রদীপের আলোয় চেয়ে দেখে বলল, “বড় ধুলো ময়লা পড়েছে দেখছি! সকালবেলাটায় তো বেশ পরিস্কার ছিল।”
“আজ্ঞে, ধুলোময়লার স্বভাবই ওই, ফাঁক পেলেই ফাঁকা জায়গায় চেপে বসে। আর ফাঁকটা অনেকটাই পেয়েছে কি না।”
সনাতন বিরক্ত হয়ে বলল, “ধরে ধরে একটু নামা তো বাপু, একটু দাঁড়িয়ে মাজাটা ছাড়াই। এই বিচ্ছিরি বাক্স থেকে বেরনোও তো ঝামেলার ব্যাপার দেখছি “
সুবদ্ধি সনাতনকে পাঁজা-কোলে তুলে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতেই সনাতন হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল, “ও বাবা, হাঁটুতে যে জোর নেই দেখছি?
“ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেড়শো বছরের পাল্লাটার কথাও তো ভাববেন।”
সনাতন অবাক হয়ে বলল, “দেড়শো বছর। কিসের দেড়শো বছর রে পাজি?”
“মুখ ফসকে একটা বাজে কথা বেরিয়ে গেছে। জিরিয়ে নিন, পারবেন।”
তা পারল সনাতন। আরও আধঘণ্টা বসে থেকে, তারপর সুবুদ্ধির কাঁধে ভর দিয়ে লগবগ করতে করতে দাঁড়াল। তারপর বলল, “নাঃ, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। বাড়ি গিয়ে একটু পান্তা না খেলেই এখন নয়।”
“হবে, হবে। বাড়ি যাবেন সে আর বেশি কথা কী? এটাও নিজের বাড়ি বলে ধরে নিতে পারেন। কথায় আছে বসুধৈব কুটুম্বকম।”
নাক সিঁটকে সনাতন বলল, “হুঃ এটা একটা বাড়ি! অঘোর পাগলের বাড়ি হল গোলোকধাঁধা। মাথার গণ্ডগোল না থাকলে কেউ মাটির নীচে ঘর করে? তা ছাড়া লোকটা ভূতপ্রেত পোষে।”
“তা বটে। তা এই অঘোর সেনের খপ্পরে আপনি পড়লেন কী করে?”
“পড়েছি কি আর সাধে? পাঁচটি হাজার টাকা পেলে জলার জমিটা কেনা যাবে। তা অঘোরবাবু বলল, কী একটা ওষুধ খেয়ে একটু ঘুমোলে পাঁচ হাজার টাকা দেবে। তা হ্যাঁ রে, জমিটা কার তা মনে পড়ছে না কেন বল তো!”
“পড়বে। একটু ঝিমুনির ভাবটা কাটতে দিন।”
“পড়বে বলছিস? আচ্ছা আমার বউ, ছেলে, বাপ, মা কারও নামই কেন মনে পড়ছে না বল তো! অঘোরবাবু আমাকে কী ওষুধই যে খাওয়াল।”
“আচ্ছা সনাতনবাবু, হিক সাহেব বলে কারও কথা আপনার মনে আছে?”
“থাকবে না কেন? সকালে তো এই ঘরেই দেখেছি। তোকে চুপি-চুপি বলে রাখি, ওই হিক সাহেব কিন্তু আস্ত ব্ৰহ্মদত্যি।”
“বটে। কিরকম ব্যাপার বলুন তো?”
সনাতন চারদিকটা চেয়ে দেখে নিয়ে বলল, “ও মনিষ্যি নয় রে।”
“তা হলে কী?”
“বললুম না, ব্রহ্মদত্যি বা দানো। ইয়া উঁচু চেহারা, দত্যিদানোর মতো মস্ত শরীর। দেখিসনি?”
“আজ্ঞে না। ও না দেখাই ভাল।”
“যা বলেছিস। তা হিক সাহেব কোথা থেকে আসে জানিস? আকাশ থেকে। তার মস্ত একটা কৌটো আছে। সেই কৌটোটা যখন আকাশ থেকে নামে তখন নন্দপুরে বিনা মেঘে বিদ্যুৎ চমকায়।”
সুবুদ্ধি অবাক হয়ে বলল, “কৌটোতে কী থাকে আজ্ঞে?”
“কেন, হিক নিজেই থাকে। ব্যাটা প্রেতলোক থেকে নেমে আসে, আবার প্রেতলোকেই ফিরে যায়। বড় সাঙ্ঘাতিক লোক। ব্ৰহ্মদত্যিটার সঙ্গে মাখামাখি করেই তো অঘোর সেনের মাথাটা বিগড়োল। নইলে একটু ঘুম পাড়াবার জন্য কেউ পাঁচ হাজার টাকা কবুল করে? হেঃ হেঃ হেঃ… কিন্তু তোকে এসব কথা বলছি কেন বল তো! তুই ব্যাটা আসলে কে? দেখে তো মনে হচ্ছে, এই মাত্র খেতে নিড়েন দিয়ে এলি।”
“আজ্ঞে ওরকমই কিছু ধরে নিন। এবার একটু জোর পাচ্ছেন শরীরে?”
“পাচ্ছি।”
“তা হলে এবার পা তুলতে হচ্ছে কর্তা। এই গর্তের ভেতর থেকে এবার না বেরোলেই নয়। কাজটা শক্ত হবে।”
সনাতন একটু হাঁটাহাঁটি করল নিজের পায়েই। একটু টালমাটাল হচ্ছিল বটে। কিন্তু কয়েকবারের চেষ্টায় পেরেও গেল। বলল, “কিন্তু অঘোরবাবু টাকাটা তো এখনও দিল না? গেল কোন চুলোয়?”
সুবুদ্ধি দেখে নিয়েছে এখান থেকে বেরনোর ওই একটাই পথ, যেটা দিয়ে সে নেমে এসেছে। ভরসা এই যে, এ ঘরে দূরদর্শী অঘোরবাবু শাবল টাবলের জোগাড় রেখেছেন, ভবিষ্যতে দরকার হতে পারে ভেবেই। নইলে, ল্যাবরেটরিতে শাবল থাকার কথা নয়। একটা টেবিল থেকে শিশি বোতল সরিয়ে সেটাকে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করাল সুবুদ্ধি। তার ওপরে সনাতনের বাক্সটাও রাখল। তারপর দরজার ফোকরটা নাগাল পেতে কোনও কষ্টই হল না।
সনাতন হাঁ করে কাণ্ডটা দেখছিল। বলল, “সিঁড়িটা ছিল যে! সেটার কী হল?”
সুবুদ্ধি বলল, “সিঁড়ি! আজ্ঞে সে আমি জানি না। চলে আসুন। এখন মেলা গা ঘামাতে হবে।”
সনাতনকে দরজার চৌকাঠে দাঁড় করিয়ে সুবুদ্ধি খুব সাবধানে শাবল দিয়ে ওপরকার মাটি সরাতে লাগল। একটু অসাবধান হলেই ওপর থেকে হুড়মুড় করে মাটির চাপড়া ঘাড়ে এসে পড়বে। তবে এসব কাজে সে খুব পাকা লোক। মাটি সরিয়ে সরিয়ে একটু একটু করে একটা ফোকর তৈরি করতে লাগল।
সনাতন ভারী বিরক্ত হয়ে বলল, “এসব কী ব্যাপার রে বাপু বল তো! এই তো কালকেও দিব্যি ফটফটে সিঁড়ি ছিল, এখানে! সেটা মাটি-চাপা পড়ল কীভাবে? ভূমিকম্প-টল্প কিছু হয়ে গেল নাকি?”