সুবুদ্ধি হতবুদ্ধি হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে বা করা উচিত, তা প্রথমটায় বুঝতে পারল না। তবে কৌতূহল জিনিসটা বড়ই সাঙ্ঘাতিক। শত বিপদের ভয় থাকলেও কৌতূহলকে চেপে রাখা কঠিন।
চাবিটি জায়গামতোই পাওয়া গেল। সুবুদ্ধি চাবিটা নিয়ে বাক্সের গা-তালায় ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে ডালাটা তুলে ফেলল। কী দেখবে, কাকে দেখবে ভেবে ভয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল সুবুদ্ধি। তারপর চোখ খুলে হাঁ করে চেয়ে রইল।
অঘোর সেন তাঁর বিবরণে যা লিখেছেন তা যদি সত্যি হয় তা হলে লোকটা দেড়শো বছরেরও বেশি ঘুমিয়ে রয়েছে এবং লোকটার বয়স একশো আটাত্তর। সেই তুলনায় সবুজ রঙের লোকটাকে নিতান্তই ছোঁকরা দেখাচ্ছে। একটু রোগাভোগা চেহারা ঠিকই। তবে দেড়শো বছর ধরে মাসে মাত্র এক ফোঁটা করে অমৃতবিন্দু খেয়ে বেঁচে থাকলে রোগা হওয়ারই কথা। কিন্তু তেমন সাঙ্ঘাতিক রোগা নয়। লোকটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বুকের ওঠানামা বা শ্বাস চলাচল বোঝাই যাচ্ছে না।
সুবুদ্ধিকে চমকে দিয়ে হঠাৎ লোকটা সেই অস্বাভাবিক চিকন স্বরে ডেকে উঠল, “অঘোরবাবু! অঘোরবাবু! আপনি কোথায়?”
সুবুদ্ধি আর ভয় পেল না। সে ভাল করে লোকটার আপাদমস্তক দেখে নিল। না, লোকটা জেগে নেই। তবে অহরহ অঘোরবাবু সম্পর্কে দুশ্চিন্তা রয়েছে বলে ঘুমের মধ্যেই অঘোরবাবুকে খুঁজে নিচ্ছে।
শিয়রের শিশিটা তুলে নিয়ে প্রদীপের আলোয় দেখে নিল সুবুদ্ধি। তরলটা সত্যিই জমে গেছে। শিশিটা প্রদীপের শিখার ওপর সাবধানে ধরল সুবুদ্ধি। মিনিট দুয়েকের মধ্যে তরলটা গলে গেল।
সনাতনকে হাঁ করাতে বেগ পেতে হল না। শরীরের জোড় আর খিলগুলো বেশ আলগা হয়ে গেছে। অর্ধেকটা ওষুধ সনাতনের মুখে ঢেলে দিল সুবুদ্ধি। তারপর নাক আর মুখ থেকে নল সরিয়ে নিল।
সনাতনের জেগে উঠতে সময় লাগবে। কিন্তু এই ঘুমন্ত লোকটার গলার স্বর পাতালঘর থেকে ওপরে কী করে গিয়ে পৌঁছত সেটা একটু অনুসন্ধান করে দেখল সুবুদ্ধি। তৃতীয় আর-একটা রবারের নল থেকে একটা চোঙার মতো জিনিস বেরিয়ে বাক্সে সনাতনের মুখের সামনেই ‘ফিট করা আছে। নলের অন্য প্রান্ত একটা ড্রামের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে ঘরের কোণে। সেখান থেকে ফের ওপরে উঠে ঘরের ছাদের ভেতরে গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। এটা বোধ হয় দেড়শো বছর আগেকার একটা পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম। হয়তোবা অঘোর সেনেরই উর্বর মাথা থেকে বেরিয়েছিল। সনাতনের হদিস যাতে ভবিষ্যতের মানুষ জানতে পারে সেইজন্যই বোধ হয় ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছিলেন।
একটু আগে যে গুণ্ডা লোকটা তাকে মেরে গর্তে ফেলে দিয়েছিল সেও অঘোর সেনের বাড়িই খুঁজছিল। কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় সুবুদ্ধি একটু দুশ্চিন্তায় পড়ল। অঘোর সেনের পাতালঘরের খবর কি তা হলে আরও কেউ-কেউ জানে?
সনাতনের চোখের পাতা কম্পিত হতে লাগল আরও আধঘণ্টা পর, শ্বাস দ্রুততর হতে লাগল। সুবুদ্ধি নাড়ি দেখে বুঝল, নাড়ির গতিও ক্রমে বাড়ছে।
আরও ঘণ্টাখানেক বাদে সনাতন মিটমিট করে তাকাতে লাগল। প্রদীপের আলোটাও যেন ওর চোখে লাগছে।
সুবুদ্ধি সনাতনের মুখের ওপর একটু ঝুঁকে বলল, “কেমন আছেন সনাতনবাবু?”
সনাতন পটাং করে চোখ মেলে তাকে দেখেই খোলা ভুতুড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “ভূ-ভূ-ত! ভূ-ভূত নাকি রে তুই? খবরদার, কাছে আসবি না। গাম… গাম… গাম… গাম…”
সুবুদ্ধি একটু লজ্জা পেল। ধুলোমাটিতে মাখা তার চেহারাখানা যে দেখনসই নয় তা তার খেয়াল ছিল না। খুব বিনয়ের সঙ্গে সে বলল, “যার নাম করতে চাইছেন তিনি গাম নন, রাম।”
সনাতন আতঙ্কের গলায় বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, রামই তো! রাম নামে ভয় খাচ্ছিস না যে বড়? অ্যাাঁ!”
“ভূত হলে তো ভয় পাব! আমি যে ভূতই নই আজ্ঞে।”
“তবে তুই কে?”
“আমার নাম সুবদ্ধি রায়। চিনবেন না। পরদেশি লোক।”
“ডাকাত নোস তো!”
“আজ্ঞে না। ডাকাত হতে এলেম লাগে। আমার তা নেই।”
সনাতন চোখ পিটপিট করতে করতে বলল, “অক্ষয়বাবু কোথায় বল তো! অক্ষয়বাবুর কাছে আমি পাঁচ হাজার টাকা পাই।”
সুবদ্ধি বুঝতে পারল, অনেকদিন ঘুমিয়ে থাকায় সনাতনের কিছু ভুলভাল হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে অঘোরবাবুর নামটা ঠিকঠাক বললেও এখন জেগে ওঠার পর স্মৃতি কিছুটা ভ্রষ্ট হয়েছে। সুবদ্ধি মাথা চুলকে বলল, “অক্ষয়বাবু বলে কাউকে চিনি না। তবে অঘোরবাবু বলে একজন ছিলেন।”
সনাতন বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, অঘোরবাবুই তো! তিনি কোথায়?”
“তিনি এখন নেই আজ্ঞে।”
সনাতন খ্যাঁক করে উঠল, “নেই মানে? কোন চুলোয় গেছেন? সনাতন বিশ্বাসের জলার জমিটা কিনব সব ঠিকঠাক হয়ে আছে। সোমবার টাকা দেওয়ার কথা।”
সুবদ্ধি একটু দোটানায় পড়ে বলল, “আজ্ঞে, যতদূর জানি, সনাতন বিশ্বাস আপনারই শ্রীনাম। নিজের জমি কি নিজে কেনা যায়? আমি অবশ্য তেমন জ্ঞানগম্যিওলা লোক নই।”
সনাতন চোখ বড়-বড় করে বলল, “আমার নাম সনাতন বিশ্বাস! হ্যাঁ, সেরকম যেন মনে হচ্ছে। আজ এত ভুলভাল হচ্ছে কেন কে জানে! অঘোরবাবুর ওষুধটা খেয়ে ইস্তক মাথাটা গেছে দেখছি। আচ্ছা, আমি একটা কলসির মধ্যে শুয়ে আছি কেন বল তো!
“কলসি! আজ্ঞে কলসির মধ্যে শোওয়া কঠিন ব্যাপার। এ হল গে যাকে বলে বাক্স। কফিনও বলতে পারেন।”
“হ্যাঁ, বাক্সই বটে। বাপের জন্মে কখনও বাক্সে শুইনি বাপ। এ নিশ্চয়ই এই বিটকেলে অঘোরবাবুর কাণ্ড। লোকটা একটা যাচ্ছেতাই।”