খুব ধীরে-ধীরে সুবুদ্ধি উঠে দাঁড়াল, তারপর হাতড়ে হাতড়ে দেখতে লাগল কোথায় কী আছে। সামনেই একটা টেবিলের মতো জিনিস। তাতে মেলা শিশি, বোতল, নানা আকৃতির বয়াম বা জার রাখা আছে। রবারের নলের মতো জিনিসও হাতে ঠেকল তার।
আরও একটু এগিয়ে সে আরও বড় একটা টেবিলে আরও বড় বড় এবং কিস্তৃত সাইজের বয়াম, শিশি আর জার ঠাহর করল। এগুলোতে কী আছে তা জানার সাহস হল না তার। তবে একটু তুলে দেখার চেষ্টা করল। বড্ড ভারী।
এর পর একটা লম্বা টানা টেবিলের ওপর রাখা কাঠের লম্বা-লম্বা বাক্স ঠাহর করল সে। এই বাক্সে গুপ্তধন থাকলেও থাকতে পারে। থেকেও অবশ্য লাভ নেই তার। এখান থেকে বেরোতে না পারলে গুপ্তধনের সঙ্গে সেও গুপ্ত এবং লুপ্ত হয়ে যাবে।
মস্ত ঘরটা ঘুরে-ঘুরে সে কিছু কোদাল আর শাবল জাতীয় জিনিসও পেল। কাজে লাগলে এগুলোই লাগতে পারে। কিন্তু আপাতত তার দরকার একটা বাতি। সে ব্যবস্থা নেই বলেই মনে হচ্ছে। তবু সে হাল ছাড়ল না। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে দু’খানা হাতকেই চোখের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে খুঁজতে লাগল। আবার প্রথম আর দ্বিতীয় টেবিল হাতড়াতে-হাতড়াতে হঠাৎ তার মনে হল, দুটো পাথর পাশাপাশি রাখা আছে। চকমকি নয় তো!
পাথর দুটো হাতে নিয়ে ঠুকবার আগে একটু ভাবল সুবুদ্ধি, মাটির নীচে এই ঘরে কী ধরনের গ্যাস জমে আছে তা জানা নেই। হঠাৎ যদি আগুন লেগে যায়, তা হলে পুড়ে মরতে হবে।
কিন্তু যা তোক একটা কিছু তো করতেই হবে। অন্ধকারটা আর সে সহ্য করতে পারছিল না। সুবুদ্ধি ঠাকুরকে স্মরণ করে ঠুক করে চকমকি ঠুকল।
ঠুকতেই এক আশ্চর্য কাণ্ড! বাঁ হাতের পাথরটা দপ করে জ্বলে উঠে একটা নীল শিখা লকলক করতে লাগল। সুবুদ্ধি ‘বাপ রে’ বলে পাথরটা ফেলে দিতেই সেটা নিভে গেল। এরকম কাণ্ড সুবুদ্ধি আগে কখনও দেখেনি।
হতবুদ্ধি হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে ফের নিচু হয়ে হাতড়ে হাতড়ে পাথরটা তুলে নিল। পাথরটায় যখন আলো হয় তখন এটাকে ব্যবহার না করারও মানে হয় না।
ফের ইকতেই যখন পাথরটা জ্বলে উঠল তখন সে চট করে চারদিকটা দেখে নিল। টেবিলের ওপর একটা পেতলের প্রদীপ রয়েছে, পাশেই একটা শিশি। শিশিতে তেল থাকার সম্ভাবনা। জ্বলন্ত পাথরটাকে টেবিলের ওপর রেখে সে সেই আলোয় শিশি থেকে প্রদীপে তেল ঢালল। তারপর জ্বলন্ত পাথর থেকে প্রদীপটা ধরিয়ে নিল। পাথরটা কিন্তু জ্বলতে-জ্বলতে দ্রুত ক্ষয়ে তারপর ফুস করে নিভে গেল, আর তার অস্তিত্বই রইল না।
প্রদীপটাই এখন তার মস্ত ভরসা। আলোটাও হচ্ছে বেশ ভাল। সাধারণ প্রদীপের আলো যেমন টিমটিম করে, এর তা নয়। বেশ সাদাটে জোরালো একটা শিখা স্থির হয়ে জ্বলছে। ষাট বা একশো ওয়াটের বালবের চেয়ে কম নয়। হতে পারে অনেকক্ষণ অন্ধকারে ছিল বলেই আলোটা এত বেশি উজ্জ্বল লাগছে তার চোখে।
ঘরখানা বেশ বড়। অন্তত কুড়ি ফুট লম্বা আর পনেরো ফুট চওড়া হবে। চারদিকে টেবিল, আর টেবিলের ওপর নানা কিস্তৃত যন্ত্রপাতি। শিশি-বোতল আর জারের অভাব নেই। একধারে লম্বা টেবিলের ওপর পরপর তিনটে কাঠের লম্বা বাক্স। বাইরে থেকে গোটা কয়েক নল বাক্সগুলোর মধ্যে কয়েকটা ফুটো দিয়ে গিয়ে ঢুকেছে। সুবুদ্ধি চারদিকে ভাল করে চেয়ে-চেয়ে দেখল। তার মনে হচ্ছিল, এটা আদ্যিকালের কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারই হবে। খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার।
হাতলওলা পিতলের প্রদীপটা নিয়ে সে চারদিক একটু ঘুরে দেখল। ঝুল, ধুলো, মাকড়সা এই নীচের ঘরেও কিছু কম জমেনি। একধারে একটা কাঁচ বসানো আলমারিতে অনেক বই
সাজানো আছে। চামড়ায় বাঁধানো বইগুলোর নাম পড়া গেল না, কাঁচে ময়লা জমে যাওয়ায়।
হঠাৎ তার সর্বাঙ্গে হিমশীতল একটা শিহরন বয়ে গেল। কে যেন শিস দেওয়ার মতো চিকন তীব্র স্বরে ডেকে উঠল, “অঘোরবাবু! অঘোরবাবু! আপনি কোথায়?”
এত চমকে গিয়েছিল সুবুদ্ধি যে, আর একটু হলেই প্রদীপটা তার হাত থেকে পড়ে যেত। স্বরটা এত তীব্র যে, সেটা এ-ঘর থেকেই হচ্ছে বলে মনে হল তার। কিন্তু এ-ঘরে কে থাকবে? অশরীরী অবশ্য হতে পারে।
কাঁপা হাতে প্রদীপটা শক্ত করে ধরে সে ধীরে-ধীরে লম্বাটে বাক্সগুলোর দিকে এগোল। ভয় পেতে-পেতে সে ভয় পাওয়ার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। এখন যা থাকে কপালে, তাই হবে।
প্রথম বাক্সটার ডালা খুলতে গিয়েই সে টের পেল, খোলা সহজ নয়। বজ্ৰ-আঁটুনি আছে।
সুবুদ্ধি প্রদীপটা ধরে ভাল করে বাক্সটা দেখল। বাক্সের গায়ে একটা পুরনো বিবর্ণ কাগজ সাঁটা। তার গায়ে বাংলা হরফেই কিছু লেখা আছে। সুবুদ্ধি নিচু হয়ে দেখল, পুঁথিতে যেমন থাকে তেমনই অদ্ভুত হাতের লেখায় সাবধান করা হয়েছে, “ইহা শ্বাস নিয়ামক যন্ত্র। বাক্সটি দয়া করিয়া খুলিবেন না। খুলিলে যন্ত্র বিকল হইবার সম্ভাবনা। “
দ্বিতীয় বাক্সটার গায়েও একটা বিবর্ণ কাগজ। তাতে লেখা, “ইহাতে মৎ আবিষ্কৃত অমৃতবিন্দুর সঞ্চার ঘটিতেছে। বৎসরে এক ফোঁটা মাত্র অমৃতবিন্দু দেহে প্রবেশ করিয়া তাহা সজীব রাখিবে। বাক্সটি দয়া করিয়া খুলিবেন না।”
তৃতীয় বাক্সটার গায়েও কাগজ সাঁটা। তাতে লেখা, “এই ব্যক্তির নাম সনাতন বিশ্বাস, অদ্য ১৮৪৫ খ্রিস্ট অব্দের সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখে ইহার বয়ঃক্রম আঠাশ বৎসর হইবেক। সনাতন অতীব দুষ্টপ্রকৃতির লোক। তাহার অখ্যাতি বিশেষ রকমের প্রবল। আমার গবেষণার জন্য ইহাকেই বাছিয়া লইয়াছি। সনাতনকে নিদ্রাভিভূত করিতে পারিলে গ্রামের মানুষ হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিবে। সনাতন অবশ্য সহজে ধরা দেয় নাই। কৌশল অবলম্বন ও প্রলোভন প্রদর্শন করিতে হইয়াছে। যে গভীর নিদ্রায় তাহাকে অভিভূত করা হইয়াছে তাহা সহজে ভাঙিবার নহে। যুগের পর যুগ কাটিয়া যাইবে, তবু নিদ্রা ভঙ্গ হইবে না। সনাতনের শ্বাসক্রিয়া ও হৃদযন্ত্রের স্পন্দনের মাত্রা অতিশয় হ্রাস করা হইয়াছে। ফলে তাহার শরীরে শোণিত চলাচল মন্দীভূত হইবে এবং ক্ষয় একপ্রকার হইবেই না। এ ব্যাপারে আমি হিক সাহেবের পরামর্শ লইয়াছি। অমৃতবিন্দুর সঞ্চার যদি অব্যাহত থাকে তবে সনাতনের প্রাণনাশের আশঙ্কা নাই। ভবিষ্যতের মনুষ্য, যদি সনাতনের সন্ধান পাইয়া থাকেন, তাহা হইলে তড়িঘড়ি করিবেন না। বাক্সটির পাশেই ইহা খুলিবার একটি চাবি পাইবেন। বাক্সটি খুব সন্তর্পণে খুলিবেন। সনাতনকে কী অবস্থায় দেখিতে পাইবেন তাহা অনুমানের বিষয়। আমি সে-বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করিতে পারিব না। তাহার গাত্রে একটি সবুজ প্রলেপ মাখানো আছে। মুখে ও নাকে নল দেখিবেন। বাক্সটি খুলিয়া খুব সন্তর্পণে কিছুক্ষণ বায়ু চলাচল করিতে দিবেন। সনাতনের শিয়রে একটি শিশিতে একটি তরল পদার্থ রাখা আছে। শত বা শতাধিক বৎসর পর তাহা হয়তো কঠিন আকার ধারণ করিবে। শিশিটি আগুনের উপর ধরিলেই পুনরায় উহা তারল্য প্রাপ্ত হইবে। সনাতনকে হাঁ করাইয়া এই শিশি হইতে সামান্য তরল পদার্থ তাহার মুখে ঢালিয়া দিবেন। তৎপর নাকের ও মুখের নল খুলিয়া দিবেন। অনুমান করি, সনাতন অতঃপর চক্ষু মেলিবে। জগদীশ্বরের কৃপায় যদি সত্যই সে চক্ষু মেলিয়া চাহে এবং পুনরুজ্জীবিত হয় তাহা হইলে আমার গবেষণা সার্থক হইয়াছে বলিয়া ধরিতে হইবে। কিন্তু সেই সাফল্যের আস্বাদ লাভ করিবার জন্য আমি তখন ধরাধামে থাকিব না। মহাশয়, পূর্বেই বলিয়াছি, সনাতন অতীব দুষ্ট প্রকৃতির লোক। পুনরুজ্জীবিত হইয়া সে কী আকার ও প্রকার ধারণ করিবে তাহা আমার অনুমানের অতীত। তবে তাহাকে যে সকল প্রলোভন দেখাইয়াছি তাহার ফলে সে যে আমার অনুসন্ধান করিবে তাহাতে সন্দেহ নাই। ঈশ্বর প্রসাদাৎ আমি তখন পরলোকে। সনাতনের বাহানা আপনাদেরই সামলাইতে হইবে। আমি শ্রীঅঘোর সেন সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে এই বিবরণ দাখিল করিলাম।”