ভেঙে পড়ে যেতে লাগল। সুবুদ্ধি ঘামছে। শ্বাসের কষ্ট এখনও শুরু হয়নি। তবে হবে। তাই সে একটু ধৈর্য হারিয়ে গর্তের একটা দেওয়ালে হাত দিয়ে খুবলে বেশ বড় একটা খাঁজ তৈরি করতে লাগল। মাটি খানিকটা খুবলে আনতে গিয়েই হঠাৎ একটা কঠিন জিনিসের স্পর্শ পেল সে। মনে হল, যেন পাথর বা ওই জাতীয় কিছু। গর্তটা সে খুবলে আরও একটু বড় করে ফেলল। তারপর হাতড়ে হাতড়ে দেখল।
প্রথমটায় পাথর বলে মনে হলেও আরও কিছু মাটি খসাবার পর দরজায় যেমন লোহার কড়া লাগানো থাকে তেমনই একটা মস্ত এবং ভারী কড়া হাতে পেল। মাটির নীচে চোর কুঠুরি থাকা বিচিত্র নয়। অনেক সময়ে এসব চোর কুঠুরিতে সোনা-দানা, টাকা-পয়সা পাওয়া যায়। সুবুদ্ধি কৌতূহলবশে ওপরে ওঠার চেষ্টা ছেড়ে কড়াটা নিয়ে নাড়াঘাটা করতে লাগল। এটা দরজাই হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু খোলা শক্ত। মাটি না সরালে খোলা যাবে না।
সুবুদ্ধি একটু জিরিয়ে নিল। ঘাম ঝরে যাচ্ছে, শরীর দুর্বল লাগছে, তেষ্টা পাচ্ছে, এই অবস্থায় হঠাৎ বেশি পরিশ্রম করলে তার দম একেবারেই ফুরিয়ে যাবে। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কাজ করছে আন্দাজে আন্দাজে। টর্চটা থাকলে কাজের সুবিধে হত।
সুবুদ্ধি কিছুক্ষণ জিরিয়ে ফের মাটি সরাতে লাগল। তাড়াহুড়ো করল না। ক্রমে-ক্রমে মাটি ঝরে গর্তটা যেন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছিল। তবে সামনে ধীরে-ধীরে একটা সরু দরজার মত জিনিস হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারল সুবুদ্ধি। একটু ধাক্কা দিয়ে দেখল। না, দরজাটা নড়ল না। আবার ধাক্কা দেওয়ার জন্য হাতটা তুলেছিল সে। হঠাৎ তার সর্বাঙ্গ যেন ভয়ে পাথর হয়ে গেল। সর্বাঙ্গে একটা হিমশীতল শিহরন। সে স্পষ্ট শুনতে পেল, মাটির তলা থেকে কে যেন ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকছে, “অঘোরবাবু! অঘোরবাবু! কোথায় গেলেন?”
মিলিটারি সুবুদ্ধিরও যেন মাথা গুলিয়ে গেল। মাটির তলায় চোরা-কুঠুরিতে অশরীরী ছাড়া তো কারও থাকার কথা নয়। তবে কি যক বলে সত্যিই কিছু আছে? এ কি সেই যকেরই কণ্ঠস্বর? জীবনে সুবুদ্ধি এত ভয় কখনও পায়নি। তার বুক ধড়াস ধড়াস করছে। হাতে পায়ে খিল ধরে গেছে।
সুবুদ্ধি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রাম নাম করল। মাটির নীচের কণ্ঠস্বর ওই একবারই ডেকে চুপ মেরে গেছে। তবে একটু আগে সে তার কার্তিক যে এই কণ্ঠস্বর শুনেছিল, তাতে সুবুদ্ধির সন্দেহ রইল না।
সুবুদ্ধি বসে বসে ভাবল, এই গভীর গর্তের মতো জায়গায় তার মরণ এমনিতেই লেখা আছে। মরতেই যদি হয় তো আর ভয়ের কী আছে? দরজাটা খুললে যদি কোনও সুড়ঙ্গটুড়ঙ্গ পাওয়া যায় তো ভাল, না হলে কপালে যা আছে হবে।
সুবুদ্ধি কড়াটা ধরে এবার নিজের দিকে টানল। কিন্তু দরজাটা নড়ল না। দরজাটা কোন দিকে খুলবে, তাও বুঝতে পারছিল না সে। টানবে না ঠেলবে, সেটাও তো বোঝা দরকার। ছিটকিনি বা ওই জাতীয় কিছু আছে কি না দেখার জন্য সুবুদ্ধি দরজাটা ফের আগাপাশতলা হাতড়াতে লাগল। একেবারে দরজার মাথায় মাটির একটা টিবলি খুবলে নিতেই একটা শিকল পেয়ে গেল সুবুদ্ধি। শিকলে একটা তালাও মারা রয়েছে। সুবুদ্ধি ভাবল, বহুকালের পুরনো তালা আর শিকল হয়তো কমজোরি হয়ে এসেছে। সে হ্যাঁচকা টান মারল।
শিকল খুলল না। তাতে হার না মেনে বারবার হ্যাঁচকা টান দিতে থাকল সে। কারণ এ ছাড়া আর পথ নেই।
অন্তত বারদশেক হ্যাঁচকা টান দেওয়ার পর হঠাৎ যেন তালা লাগানোর আংটাটা একটু নড়বড়ে মনে হতে লাগল। উৎসাহের চোটে সুবুদ্ধি দ্বিগুণ জোরে হ্যাঁচকা মেরে তালা ধরে প্রায় ঝুলে পড়ল। তাতে আংটা খুলে তালাটা পটাং করে এসে সুবুদ্ধির মাথায় লেগে একটা আলু তুলে দিল।
কিছুক্ষণ মাথাটা ঝিমঝিম করল সুবুদ্ধির। ক্ষতস্থান থেকে রক্তও পড়ছিল। সুবুদ্ধি খানিকটা মাটি নিয়ে ক্ষতস্থানে চাপা দিল। এর চেয়ে ভাল ফার্স্ট এইড এখন আর কী হতে পারে!
খুব ধীরে-ধীরে দরজাটা ঠেলল সুবুদ্ধি। বহুকালের পুরনো জং-ধরা কবজা আর এঁটেল মাটিতে আটকে যাওয়া পাল্লা সহজে খুলল না। বেশ খানিকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর অল্প-অল্প করে দরজাটা ওপাশে সরতে লাগল। তারপর সরু একটা ফালি ফোকর উন্মোচিত হয়ে গেল সুবুদ্ধির সামনে। ভেতরে একটা বহুকালের পুরনো সোঁদা বাতাসের গন্ধ।
সুবুদ্ধি সন্তর্পণে দরজার ফাঁকটায় দাঁড়িয়ে ভেতরের অবস্থাটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল। সামনে কোন বিপদ অপেক্ষা করছে তার ঠিক কী? পা বাড়িয়ে সে দেখল, সামনে মেঝে বলে কোনও জিনিস নেই। তার পা ফাঁকায় খানিকক্ষণ আঁকপাকু করে ফিরে এল। খুব চাপা একটা শিস দিল সুবুদ্ধি। শিসের শব্দটা বেশ খানিকটা দূর অবধি চলে গেল। অর্থাৎ ঘরটা ছোট নয়। সুবুদ্ধি একটা মাটির ঢেলা নিয়ে ফেলল নীচে। অন্তত দশ ফুট নীচে ঢেলাটা থপ করে পড়ল।
দশ ফুট লাফ দিয়ে নামা সুবুদ্ধির কাছে শক্ত কিছু নয়। প্যারাট্রুপারের ট্রেনিংয়ের সময় এরকম লাফ সে বহু দিয়েছে। তবে চিন্তার বিষয় হল, নীচে কী আছে তা না জেনে লাফ মারলে বিপদ হতে পারে। নীচে আসবাবপত্র, কাঁচের জিনিস বা
পেরেক-টেরেক থাকলে বিপদের কথা। সুবুদ্ধি তাই নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে দেখল নীচে নামবার কোনও মই-টই কিছু আছে কি না, নেই।
সুবুদ্ধি হুট করে লাফ না দিয়ে দরজার চৌকাঠ ধরে আগে নিজের শরীরটাকে নীচে ঝুলিয়ে দিল। তারপর হাত ছেড়ে দিতেই দড়াম করে পড়ল নীচে একটা বাঁধানো জায়গায়। পড়েই অভ্যাসবশে গড়িয়ে যাওয়ায় চোট বিশেষ হল না।