“কিন্তু তুমি টর্চ নিয়ে চললে কোথায়? শব্দটা কোথা থেকে আসছে, কে করছে তা না জেনে হুট করে বেরিয়ে পড়লেই তো কাজ হবে না। মনে হচ্ছে শব্দটা বেশ দূর থেকে আসছে।”
সুবুদ্ধি চিন্তিত মুখে বলল, “ভাবছি পাড়াটা একটা চক্কর দিয়ে আসব। তুই বরং ঘুমিয়ে থাক, আমি বাইরে তালা দিয়ে যাচ্ছি।”
কার্তিক তড়াক করে উঠে পড়ে বলল, “পাগল নাকি? আমি এই ভুতুড়ে বাড়িতে একা থাকতে গেছি আর কি! চলো, আমিও সঙ্গে যাই।”
সুবুদ্ধি একটু ভেবে তার লাঠিটাও নিয়ে নিল। দরজায় তালা
লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল দুজনে।
রাস্তাঘাট অতীব নির্জন। রাস্তায় কুকুরটা বেড়ালটা অবধি দেখা যাচ্ছে না। আশপাশে যে দু-চারটে বাড়ি আছে, সব অন্ধকার। সুবুদ্ধি হাঁটতে-হাঁটতে বলল, “শব্দটা কোন দিক থেকে আসছিল বল তো?”
কার্তিক মাথা নেড়ে বলল, “বলতে পারব না। ভুলও শুনে থাকতে পারি।”
“দু’জনেই শুনেছি। ভুল বলে মনে হচ্ছে না।”
গোটা পাড়াটা ঘুরে-ঘুরে দেখল তারা। কোথাও কারও বিপদ হয়েছে বলে মনে হল না।
কার্তিক বলল, “চলো মামা, ফেরা যাক।”
সুবুদ্ধি মাথা নেড়ে বলল, “তাই চল।”
নিজেদের বাড়ির দরজায় এসে দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তালাটা ভাঙা, দরজার একটা পাল্লা হাঁ হয়ে খোলা।
কার্তিক ভয়ার্ত গলায় বলল, “মামা, এ কী?”
সুবুদ্ধি চাপা গলায় বলল, “চুপ। শব্দ করিস না। চোর ঢুকেছে মনে হচ্ছে। শব্দ করলে পালাবে।”
কার্তিক মামার হাত চেপে ধরে বলল, “ভেতরে ঢুকো না মামা। চোর হলে তোমাকে মেরে বসবে।”
সুবুদ্ধি হাসল। বলল, “মারতে আমিও জানি। মিলিটারিতে কি ঘাস কাটতুম রে? তুই বরং বাইরেই থাক। আমি দেখছি।”
সুবুদ্ধি ঘরে ঢুকে দেখল, ভেতরে যে হ্যারিকেনটা তারা জ্বালিয়ে গিয়েছিল, সেটা নেভানো। অন্ধকার হলেও সুবুদ্ধি ঠাহর করে বুঝল, প্রথম ঘরটায় কেউ নেই। থাকলে সুবুদ্ধির তীক্ষ্ণ কানে শ্বাসের শব্দ ধরা পড়ত। দ্বিতীয় ঘরটাতেও কেউ ছিল না। সেটা পেরিয়ে তিন নম্বর ঘরটায় ঢুকবার মুখেই সুবুদ্ধি থমকে দাঁড়াল। তার প্রখর অনুভূতি বলল, এ-ঘরে কেউ আছে। কিন্তু কে?
অন্ধকার এবং অজানা প্রতিপক্ষ সামনে থাকলে একটু কৌশল নিতেই হয়। সুবুদ্ধি তাই সোজা ঘরটায় ঢুকল না। উবু হয়ে বসে হামাগুড়ি দিয়ে চৌকাঠটা পেরিয়ে সে আবছা দেখতে পেল, ঘরের মেঝের গর্তটার সামনে একটা বিরাট চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। সুবুদ্ধি লাঠিটা বাগিয়ে ধরে রইল, কিন্তু কিছু করল না। সে শুনতে পেল লোকটা বিড়বিড় করে বলল, “এটাই কি অঘোর সেনের বাড়ি? এটাই কি…”
সুবুদ্ধি সাহসী হলেও হিংস্র নয়। সে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল।
সুবুদ্ধি একটু গলাখাঁকারি দিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে না, এটা অঘোর সেন মশাইয়ের বাড়ি নয়।”
লোকটা বিদ্যুদ্বেগে ফিরে দাঁড়াল। অতবড় শরীরটা যে এমন চিতাবাঘের মতো দ্রুত নড়াচড়া করতে পারে, তা দেখে সুবুদ্ধি
অবাক হল। লোকটা চাপা হিংস্র গলায় বলল, “তুই কে?”
সুবুদ্ধি আরও বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আমার নাম সুবুদ্ধি। সম্প্রতি এই বাড়িটা কিনেছি। কিছু যদি মনে করেন তো বলি, তালা ভেঙে বাড়িতে ঢোকাটা আপনার ঠিক হয়নি। চোর-ছ্যাঁচড়রাই এমন কাজ করে।”
কথাটা শেষ করেছে কি করেনি, কী যে একটা ঘটে গেল, তা সুবুদ্ধি বুঝতেই পারল না। প্রথমে তার মুখে একটা প্রবল ঘুসি মুগুরের মতো এসে পড়ল। তাতেই মাথা অন্ধকার হয়ে গেল সুবুদ্ধির। আর সেই অবস্থাতেও টের পেল কেউ তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে গর্তের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর সুবুদ্ধির আর জ্ঞান নেই।
সুবুদ্ধি কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিল, তা সে বলতে পারবে না। তবে তার জ্ঞান যখন ফিরল তখন সে দুটো জিনিস টের পেল। এক, তার চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। আর দুই হল, সে অজ্ঞান অবস্থাতেও হাঁটু মুড়ে বসে আছে।
মিলিটারিতে ছিল বলে সুবুদ্ধির সহ্যশক্তি আর সাহস দুটোই প্রচুর। গায়ের জোরও খুব কম নয়। নিজের অবস্থাটা বুঝতে তার খানিকটা সময় লাগল। চারদিকে হাতড়ে দেখল, সে একটা বেশ অপরিসর গর্তের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। নীচে-ওপরে কোথাও কোনও রন্ধ্র আছে বলে মনে হচ্ছে না। তার ওপরে একটা ফুটো নিশ্চয়ই আছে, নইলে সে এখানে এসে সেঁধোয় কী করে!
সুবুদ্ধি উঠে দাঁড়িয়ে ওপর দিকটা হাতড়ে দেখল। কিছুই নাগাল পেল না। চেঁচিয়ে কার্তিককে কয়েকবার ডাকল, বুঝতে পারল ঘরের গর্তটা কেউ বুজিয়ে দিয়েছে, গলার স্বর ওপরে যাচ্ছে না।
সাহসী সুবুদ্ধির একটু ভয়-ভয় করতে লাগল। এখনই যদি কিছু করা না যায়, তা হলে এই কবরের মধ্যে অক্সিজেনের অভাবে তার মৃত্যু অনিবার্য। গর্তের ভেতরে ভ্যাপসা গরমে তার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।
সুবুদ্ধি ওপরে ওঠার ফিকির খুঁজতে লাগল। ওপরে ওঠা ছাড়া বেরোবার তো পথ নেই। কাজটা শক্ত নয়। গর্তটার খাঁজে-খাঁজে পা রেখে ওঠা সহজ ব্যাপার। সুবুদ্ধি চারদিকটা হাতড়ে দেখে নিল। নরম মাটি। খাঁজখোঁজও অনেক। সুবুদ্ধি একটা খাঁজে পা রেখে ভর দিয়ে উঠতে গিয়েই হড়াস করে মাটির দেওয়াল খসে ফের নীচে পড়ল। কিন্তু ধৈর্য হারালে চলবে না। নরম মাটিতে আবার একটা গভীর খাঁজ তৈরি করে নিল সে। কিন্তু মাটি বড্ডই নরম। খাঁজ ভেঙে মাটির চাপড়া খসে পড়ে গেল।
গাছের শেকড়-বাকড় থাকলে ভাল হত। কিন্তু তা নেই। বারবার চেষ্টা করতে লাগল সুবুদ্ধি, আর বারবার মাটির চাপড়া