- বইয়ের নামঃ পাতালঘর
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. ও বাড়িতে কি ভূত আছে
পাতালঘর – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
“আচ্ছা, ও বাড়িতে কি ভূত আছে মশাই?”
নরহরিবাবু অবাক হয়ে বললেন, “ভূত! বাড়ির সঙ্গে আবার ভূতও চাই নাকি আপনার? আচ্ছা আবদার তো মশাই! শস্তায় বাড়িটা পাচ্ছেন, সেই ঢের, তার সঙ্গে আবার ভূত চাইলে পারব না মশাই। ভূত চাইলে অন্য বাড়ি দেখুন। ওই নরেন বক্সির বাড়ি কিনুন, মেলা ভূত পাবেন।”
সুবুদ্ধি জিভ কেটে বলল, “আরে ছিঃ ছিঃ, ভূত চাইব কেন? ওটা কি চাইবার জিনিস? বলছিলাম কি পুরনো বাড়ি তো, অনেক সময়ে পুরনো বাড়িতেই তাঁরা থাকেন কিনা।”
নরহরিবাবু এ-কথাটা শুনেও বিশেষ খুশি হলেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন, “পুরনো বাড়ি হলেই ভূত থাকবে এমন কোনও কথা নেই। ভূত অত শস্তা নয়। ভূত যদি থাকত তা হলে আরও লাখদুয়েক টাকা বেশি দর হাঁকতে পারতুম। কপালটাই আমার খারাপ। কলকাতার বিখ্যাত ভূতসন্ধানী ভূতনাথ নন্দী মাত্র ছ’মাস আগে এসে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যদি ভূতের গ্যারান্টি থাকে তবে তিন লক্ষ টাকা দিতে রাজি আছি।’ বুঝলেন মশাই, ভূত থাকলে এত শস্তায় মাত্র এক লাখ টাকায় বাড়িটা আপনি পেতেন না।”
সুবুদ্ধি ঘাড় নেড়ে বলল, “বুঝেছি। ভূতের দাম আছে দেখছি।”
“চড়া দাম মশাই, চড়া দাম। অথচ কপালটা খারাপ না হলে দেড়শো বছরের পুরনো বাড়িতে এক-আধটা ভূত কি থাকতে পারত না? কিন্তু ব্যাটারা যে কোথায় হাওয়া হল কে জানে! বোম্বাইয়ের থিওসফিক্যাল সোসাইটির কিছু আড়কাঠিও এসেছিল ভূতের বাড়ির খোঁজে। তারাও ও-বাড়ি ভাড়া নিয়ে কয়েকদিন ছিল। ভূতের গায়ের আঁশটিও দেখতে পায়নি।”
সুবুদ্ধি হঠাৎ বলল, “ভূতের গায়ে কি আঁশ থাকে নরহরিবাবু?”
নরহরিবাবু উদাস হয়ে বললেন, “কে জানে কী থাকে! আঁশও থাকতে পারে, বড়বড় লোমও থাকতে পারে।”
“নরেন বক্সির বাড়ির কথা কী যেন বলছিলেন!”
নরহরিবাবু গলাটা একটু খাটো করে বললেন, “ওর বাড়িতেও ভূতফুত কিছু নেই মশাই। সব ফকিকারি। ভূতনাথ নন্দীকে ভজিয়ে বাড়িটা দেড় লাখ বেশি দামে গছাল। রাত্রিবেলা মেজো ছেলে গোপালকে ভূত সাজিয়ে পাঠিয়েছিল। গোপাল সাদা চাঁদর চাপা দিয়ে খানিক নাচানাচি করে এল উঠোনে। নাকিগলায় কথাটথাও বলেছিল। তাইতেই ভূতনাথবাবু খুব ইমপ্রেচ্ছ। খুশি হয়ে বাড়িটা কিনে ফেললেন। তবে তিনি ব্যস্ত মানুষ, বিশেষ আসেন না। বাড়িটা পড়েই থাকে।”
সুবুদ্ধি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, “যাক, বাড়িটায় ভূত নেই জেনে ভারী নিশ্চিন্ত হলাম। পুরনো বাড়ি বলে একটু খুঁতখুতুনি ছিল।”
একথায় নরহরিবাবু একেবারেই খুশি হলেন না। একটু যেন চটে উঠেই বললেন, “আপনি তো ভূত নেই বলে খুশি হয়েই খালাস। কিন্তু ভূত না থাকাটা কি ভাল? যত দিন যাচ্ছে ততই ভূতের চাহিদা বাড়ছে। চারদিকে এখন ‘ভূত নেই’, ‘ভগবান নেই’ বলে একটা হাওয়া উঠেছে। যতই হাওয়াটা জোরদার হচ্ছে ততই লোক ভূত দেখার জন্য হামলে পড়ছে। আর যতই হামলে পড়ছে ততই ভূতেরা গা-ঢাকা দিচ্ছে। তাতে লাভটা হচ্ছে কার?”
সুবুদ্ধি একটু হতবুদ্ধি হয়ে বলল, “তা বটে!”
“আপনি তো ‘তা বটে’ বলেই মুখ মুছে ফেললেন, কিন্তু আমার ক্ষতিটা বিবেচনা করেছেন? আমার এ-তল্লাটে সোয়াশো দেড়শো বছরের পুরনো আরও পাঁচখানা বাড়ি আছে। ভূত না থাকলে সেগুলোর দর উঠবে? নোনায় ধরেছে, ঝুরঝুর করে চুনবালি খসে পড়ছে। দেওয়াল ফেটে হাঁ হয়ে তক্ষকের বাসা হয়েছে, অশ্বথ গাছ উঠছে, ওসব বাড়ির দামই বা কী? ওদিকে ভূতনাথ নন্দী বলে রেখেছেন খাঁটি ভূত থাকলে তিনি প্রত্যেকটা বাড়ি আড়াই তিন লাখে কিনে নেবেন। কিন্তু কপালটাই এমন যে, কী বলব। মতি ওঝাকে দিয়ে সবকটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজিয়েছি। সে মেলা মন্ত্রটন্ত্র পড়ে ভাল করে দেখে এসে বলেছে, আপনার নসিবটাই খারাপ। কুনো বাড়িতে ভূতটুত কুছু নাই। সব সাফা কোঠি আছে। আমি তো আর নরেন বক্সি নই যে, ভেজাল ভূত চালিয়ে দেব! আমি হলাম হরি ময়রার প্রপৌত্র। আমাদের বংশে কেউ কখনও দুধে জল বা রসগোল্লায় সুজি মেশায়নি। সেই বংশের ছেলে হয়ে কি আমি ভূতে ভেজাল দিতে পারি?”
সুবুদ্ধি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো মাথা নেড়ে বলল, “তা তো বটেই।”
“তাই বলছিলাম মশাই, ভূত নেই বলে আপনার তো আনন্দই হচ্ছে, কিন্তু আমার তো তা হচ্ছে না। একেই বলে কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।”
সুবুদ্ধি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “যা বলেছেন!”।
নরহরিবাবু কটমট করে সুবুদ্ধির দিকে চেয়ে বললেন, “তা হলে যান, গিয়ে নেই-ভূতের বাড়িতে সুখে থাকুন গে।”
সুবুদ্ধি এতক্ষণ বড় অস্বস্তি বোধ করছিল। ধমক খেয়ে পালিয়ে বাঁচল। সঙ্গে তার ভাগ্নে কার্তিক।
রাস্তায় এসে কার্তিক বলল, “মামা, ভূতের যে এত দাম তা জানতাম না তো!”
“আমিই কি জানতাম? যাক বাবা, বাড়িটায় ভূত নেই এটাই বাঁচোয়া।”
কার্তিকের বয়স বছর পনেরো। বেশ চালাক-চতুর ছেলে। বলল, “ভূত থাকলেই ভাল হত কিন্তু মামা। ভূত দেখার মজাও হত, আবার ভূতনাথবাবুকে বেশি দামে বেচেও দেওয়া যেত।”
সুবুদ্ধি নরহরিবাবুর মতোই কটমট করে কার্তিকের দিকে চেয়ে বলল, “তোরও ঘাড়ে ভূত চাপল নাকি? ওসব কথা উচ্চারণও করতে নেই।”