জগুরাম খুবই উদাস মুখে বলল, “তো ক্যা হুয়া? চোর-ডাকু কোই হোগা। শো যাও।”
লোকটার এরকম উদাসীনতা দেখে হরি ভারী রেগে গেল। বলল, “চোর এসেছিল শুনেও তুমি গা করছ না?”
এর জবাবে জগুরাম যা বলল, তার তুলনা নেই। সে হিন্দিতে বলল, “দুনিয়াটাই চোরচোট্টায় ভরে গেছে। তারা আর যাবেই বা কোথায়? আর রাতে ছাড়া তাদের কাজের সুবিধেও হয় না কিনা! এখানে চোর-ডাকাত মেলাই আছে। ওসব নিয়ে ভাবলে মোতিগঞ্জে থাকাই যেত না।”
জগুরাম চলে যাওয়ার পর হরি আর ঘুমোতে পারল না। ঘড়িতে দেখল রাত সাড়ে তিনটে। হ্যারিকেনের আলো বাড়িয়ে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। ভাবল, এখানে যদি থাকতেই হয় তা হলে ভয়ডর ঝেড়ে ফেলতে হবে। চোর-ডাকাত যে-ই এসে থাকুক, সে ভয় পেয়েছে জানলে ফের আসবে।
হরি টর্চ আর লাঠি নিয়ে উঠল। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। টর্চ জ্বেলে জানালার নীচের মাটি প্রথমে পরীক্ষা করল হরি।
পায়ের ছাপ ভাল বোঝা গেল না বটে, তবে কয়েকটা পাতাবাহারের গাছ ভেঙে থেতলে গেছে।
ছায়ামূর্তিটা ডান দিকে সরে গিয়েছিল। সুতরাং হরি টর্চ নিবিয়ে সেদিকেই সন্তর্পণে এগোল। শেষ রাতে ফিকে একটু জ্যোৎস্না দেখা দিয়েছে। কুয়াশায় মাখা সেই জ্যোৎস্নায় চারদিকটা ভারী ভুতুড়ে আর অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এ যেন মানুষের রাজ্য নয়, কোনও রূপকথার জগৎ।
বাগানের এপাশটায় অনেক ঝুপসি গাছপালা। তার ছায়ায় গাঢ় অন্ধকারে মৃদু জ্যোৎস্নার ইকড়ি-মিকড়ি। হরি চারদিকে চেয়ে পরিস্থিতিটা বুঝবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল বাগানের পাঁচিলটা এক জায়গায় ভাঙা। আর সেই ভাঙা জায়গাটায় একটা লোক যেন গুঁড়ি মেরে বসে আছে।
হরি গাছের ছায়ায় ছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে এগোতে লাগল। তার যে ভয় না করছিল এমন নয়। কিন্তু আজ রাতে সে ভয় নিকেশ করতে বদ্ধপরিকর। মোতিগঞ্জে টিকে থাকতে গেলে বুকের পাটা চাই।
লোকটাও অদ্ভুত। ভাঙা পাঁচিলটায় উঠে স্থির হয়ে বসে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে সামনের দিকে কিছু দেখছে বোধহয়! হরির দিকে তার পিঠ।
লোকটার কাছে গিয়ে হরি হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরে চাপা গলায় বলল, “একটু নড়েছ কি মাথা ফাটিয়ে দেব। চুপচাপ সুড়সুড় করে ভাল ছেলের মতো নেমে এসো।”
লোকটা খুব আস্তে ঘাড় ঘোরাল। তাকে খুবই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে মুখে আঙুল তুলে ফিসফিস করে বলল, “চুপ। শব্দ করলেই বিপদ।”
হরি লাঠিটা উঁচিয়ে বলল, “আবার চোখ রাঙানো হচ্ছে? একটু আগেই
তুমি আমার জানালায় উঁকি মেরেছিলে? চোর কোথাকার।”
লোকটাও খ্যাঁক করে উঠল, “হুঁ, জানালায় উঁকি মারলেই বুঝি চোর হয়ে যায় লোকে! বেশ কথা তো! উঁকি দিয়েছি তো কী হয়েছে, কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়েছে তাতে?”
হরি অবাক হয়ে বলল, “তাই বলে মাঝরাত্তিরে উঁকি দেবে?”
“ওঃ, খুব পাপ হয়েছে বুঝি? পাড়ায় নতুন কে লোক এল তাই দেখতে একটু উঁকি দিয়েছি, আর অমনি বাবা কী চিল-চ্যাঁচানি! যেন ওঁর সর্বস্ব নিয়ে ভেঙ্গে পড়েছি। নেওয়ার তোমার আছেটাই বা কী হে ছোঁকরা? একটা টিনের তোরঙ্গ আর গুচ্ছের বইখাতা। ছ্যাঃ, ওসব ছোঁবে কোন্ চোরে?”
“তা হলে তুমি চোর নও?”
লোকটা এবার একটু নরম গলায় বলল, “চোর হতে যাব কোন্ দুঃখে? আমার প্যালারাম রেলে চাকরি পেয়ে গেছে না? এখন আর কে চুরি করে? বুড়ো বয়সে ওসব কি আর পোয়? তবে যদি সত্যিই চুরি করার মতলব থাকত, তবে কি আর তোমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙত হে ছোঁকরা? এই পটল দাসের এলেম তো জানো না, তোমার তলা থেকে বালিশ বিছানা অবধি সরিয়ে ফেলতুম, তুমি টেরটিও পেতে না।”
বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোট্টা চেহারার বয়স্ক লোকটিকে এবার একটু ভাল করে দেখল হরি। মুখে কাঁচাপাকা একটু দাড়ি আর গোঁফ আছে। মাথায় একটা পুরনো উলের টুপি। গায়ে একখানা খাকি রঙের ছেঁড়া সোয়েটার। পরনে ধুতি। পায়ে কেস আর মোজা। চোখে ধূর্ত দৃষ্টি। হরি টর্চটা নিবিয়ে ফেলে বলল, “তা হলে তুমি চোর ছিলে?”
“ছিলুম তো ছিলুম। অত খতেন কিসের? চোর হলেও আজকালকার ছোঁকরা-চোরদের মতো গবেটচন্দ্র ছিলুম না। চরণ, ছিদাম, দুখে, এদের জিজ্ঞেস করে দেখো, পটল দাসের নাম শুনলেই জোড়হাত করে কপালে ঠেকাবে। চোর কথাটা শুনতে খারাপ, কিন্তু এলেম দেখালে সব কাজেই ইজ্জত আছে। তবে এই হালের ছোঁড়ারা মানতে চায় না। তা না মানুক।”
হরি লাঠিটা নামাল, লোকটাকে ভয়ের কিছু নেই। তবু মুখে বলল, “জগুরামকে ডাকলে এক্ষুনি তোমাকে ধরে পুলিশে দেবে।”
“কোন্ আইনে? চুরি করতে গিয়ে তো ধরা পড়িনি হে। তার ওপর পুলিশ কি হাতের মোয়া যে ডাকলেই পাবে? এখান থেকে থানা মাইলটাক দূরে। দারোগাবাবু কনেস্টবলবাবারা এ-সময়ে ঘুমোন, ডাকলে ভারী রেগে যান।”
হরি হেসে ফেলল। তারপর বলল, “তা তুমি ওই ভাঙা পাঁচিলে উঠে কী করছ? নেমে এসো। আজ তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি।”
“ছাড়তে হবে না। আমি তো ধরাও পড়িনি এখনও। ছাড়বার তুমি কে। হে? ভাবছিলাম ভদ্রবাবুদের বাড়িটা এই ফাঁকে একটু দেখে যাব। দিনে কালে এবাড়ি থেকে কত কী সরিয়েছি। কিন্তু ঢুকতে ঠিক সাহস হচ্ছে না। কী যেন একটা দেখলাম। ভাল করে দেখার জন্য ঘাপটি মেরে বসে আছি তখন থেকে।”
“কী দেখেছ?”
“কী দেখেছি সেইটেই তো ঠিক বুঝতে পারছি না। সেই আগের চোখও নেই। বাঁ চোখটায় ছানি এসেছে। প্যালারাম অবশ্য বলেছে শহরে নিয়ে গিয়ে চোখ কাটিয়ে আনবে। তখন সব আবার আগের মতো দেখতে পাব।”