কিছুক্ষণ পর বাটিতে হাত দিয়ে সে অবাক হয়ে দেখল, ছাতুর তালটা আর নেই। বাটি একেবারে ভোঁভাঁ। ভারী অবাক হল সে। ইঁদুর বা ছুঁচো এসে নিয়ে যায়নি তো মুখে করে?
না। সে টের পেল ছাতুর তালটা উধাও হয়েছে বটে, কিন্তু পুরোটাই সেঁধিয়েছে তার পেটে। নিজের পেটের দিকে অবিশ্বাসভরে চেয়ে রইল হরি। যখন আর সন্দেহ রইল না, তখন ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিল।
বাইরে বেশ ঘুটঘুট্টি অন্ধকার জমে উঠেছে। পুরনো বাড়ির নানা জায়গা থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ আসছে। একটা আলগা পাল্লা মাঝে-মাঝে খটাস করে বন্ধ হচ্ছে, আবার ক্যাঁচক্যাঁচ করে খুলে যাচ্ছে। ধেড়ে ইঁদুর ডেকে উঠল যেন কোনও ঘরে। একটা বেড়াল মিউমিউ করে দোতলার কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাছেপিঠে কোথায় যেন শিয়াল ডেকে উঠল এক ঝাঁক।
এবাড়িতে একা ঘরে রাতটা কী করে সে কাটাবে? শুধু একটা রাতই তো নয়, রাতের পর রাত!
আবার পরমুহূর্তেই বাড়ির কথা ভেবে তার মনটা রা, আর অভিমানে ভরে গেল। একা এই নিবান্ধব পুরীতে তাকে নির্বাসনেই তো পাঠানো হয়েছে। সে মরুক বাঁচুক, তাতে কার কী আসে-যায়? ভাবতে ভাবতে তার চোখে জল চলে এল। গোবিন্দদার হাত দিয়ে সে মা’কে একটা চিঠি পাঠিয়েছে : ‘আমি এখানে থাকলে বেশিদিন বাঁচব না, তোমার পায়ে পড়ি মা, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাবাকে বলো।
এখন তার চিঠিটার জন্য লজ্জা করতে লাগল। ওরকম চিঠি না লিখলেই পারত।
স্কুলে অনেক টাস্ক দিয়েছে। এই স্কুলে হোমটাস্ক জিনিসটা সাঙ্ঘাতিক। প্রত্যেকটা খাতা খুঁটিয়ে পড়া হয়, নম্বর দেওয়া হয়। টাস্ক না করলে লাঞ্ছনা-অপমানের একশেষ।
চোখের জল মুছে টেবিলের ওপর বইখাতা সাজিয়ে বসে গেল হরি। টাস্ক করতে করতে ভয়ের ভাবটাও কমে আসতে লাগল। মাঝে-মাঝে জানালা দিয়ে চেয়ে সে দরোয়ান জগুরামের ঘরে টেমির আলো দেখতে পাচ্ছিল। ঝুমরি বোধহয় রান্না করতে করতে একখানা গান ধরল। দেহাতি গান। অনেকটা কান্নার মতো বিষণ্ণ সুর। মাঝে-মাঝে আনমনে শুনতে পাচ্ছিল হরি।
রাত দশটা নাগাদ হরির হঠাৎ খেয়াল হল, কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। শরীরের মধ্যে যেন একটা ফাঁকা-ফাঁকা ভাব। পেনসিলটা দাঁতে কামড়ে ব্যাপারটা একটু বুঝবার চেষ্টা করল হরি। খানিকক্ষণ চিন্তা করার পর হঠাৎই ব্যাপারটা তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ফাঁকাই বটে, তার পেটটাই বিলকুল ফাঁকা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বিকেলে যে। প্রকাণ্ড ছাতুর তালটা সে আনমনে খেয়ে নিয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে পেট থেকে। মোতিগঞ্জের জল-হাওয়া বোধহয় খুবই ভাল।
আরও আশ্চর্যের বিষয়, খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল ঝুমরি। হাতে থালা। থালার ওপর গরম ধোঁয়ানো ভাতের একটা পাহাড়। সঙ্গে অড়হরের ডাল, তরকারি।
ভাতের পরিমাণ দেখে আঁতকে উঠে হরি বলল, “অত আমি খেতে পারব না। কমিয়ে আনো।”
ঝুমরি কথাটা গায়েই মাখল না। থালা রেখে জল গড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।
অগত্যা হরি খেতে বসল। আশ্চর্যের বিষয়, পাহাড়টা অর্ধেক তার পেটে সেঁধিয়ে যাওয়ার পরও পেটটা বেশ ফাঁকা-ফাঁকাই লাগছিল হরির। একা-একা বসেও এত ভাত খেতে হরির একটু লজ্জা লাগতে লাগল।
পুরো পাহাড়টা শেষ করে যখন উঠল হরি, তখন নিজের খাওয়ার বহর দেখে সে নিজেও অবাক হয়ে গেল।
৪. রাত্রিবেলা একা ঘরে শুতে
রাত্রিবেলা একা ঘরে শুতে একটু ভয় ভয় করছিল হরির। জীবনে সে কখনও একা ঘরে শোয়নি, একখানা গোটা বাড়িতে একা শোওয়া তো দুরস্থান। তার ওপর সাহেবপাড়ার মতো নির্জন জায়গায়।
কিন্তু উপায়ই বা কী? হ্যারিকেনের সলতে কমিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে সে নিঃসাড়ে শুয়ে নিজের বুকের ঢিবঢিবিনি শুনল কিছুক্ষণ। ইঁদুরের শব্দ, বাতাসের শব্দ, শেয়াল বা বেড়ালের ডাক, সবই তার চেনা। ঝিঁঝির ডাকও সে কতই শুনেছে। তবু এই অচেনা নির্জন জায়গায় সব কটা শব্দই তার ভুতুড়ে বলে মনে হচ্ছিল। ঘুম আসছিল না।
তবে পেটে ছাতু ও ভাতের যে দুটি পাহাড় ঢুকেছে, তার প্রভাবে এবং লেপের ওমের ভিতরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পরেই নিজের অজান্তে তার ঘুম এসে গেল।
ঘুমটা ভাঙল মাঝরাতে। কী একটা অনির্দেশ্য অস্বস্তি, মনের মধ্যে একটা সুড়সুড়ি, একটা রহস্যময় কিছু ঘুমের মধ্যেও টের পেয়ে আচমকা সে চোখ মেলল। মেলেই সে পট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শিয়রের জানালার দিকে।
জানালার বাইরে ফিকে অন্ধকার, একটা ঝুপসি গাছ। বন্ধ কাঁচের শার্সির গায়ে একটা ছায়া কি? অনেকটা মানুষের আকৃতির মতো? চোখটা দুহাতে রগড়ে নিয়ে আবার চাইল হরি। কোনও ভুল নেই। একটা লোক শার্সির ওপাশ থেকে চেয়ে আছে ঘরের মধ্যে।
হরি কিছু না ভেবে-চিন্তেই বালিশের পাশ থেকে টর্চ আর পাশে শোয়ানো লাঠিটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে “কে, কে, কে ওখানে” বলে বিকট চেঁচিয়ে উঠল।
ছায়াটা টক করে সরে গেল।
হরি দৌড়ে গিয়ে জানালা খুলে চেঁচিয়ে উঠল, “ও জগুরাম? জগুরা-আ-ম।”
দারোয়ানের ঘর তার ঘর থেকে দেখা যায়। জগুরামের ঘরে একটা টেমি উশকে উঠল। দরজা খোলার শব্দ হল। জগুরাম বেরিয়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে কাছে এসে বলল, “ক্যা হুয়া?”
উত্তেজিতভাবে হরি বলে উঠল, “আমার জানালায় একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল।”