হরিবন্ধু লজ্জিত হয়ে বলে, “না না, এগিয়ে দিতে হবে না।”
আজ আর ছুটির পর হরিবন্ধু অপেক্ষা করল না। বইখাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। স্কুলের ফটক থেকেই গোপাল অন্য দিকে রওনা হয়ে যাওয়ার পর হরি একা, ছেলেদের দঙ্গল থেকে একটু তফাতে থেকে বাড়িমুখো হাঁটতে লাগল। হাঁটতে-হাঁটতে সে গোপালের কথাই ভাবছিল। এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ক্লাসের সব ছেলেই গোপালকে ভয় পায়, কিন্তু কেন পায় সেটাই তাকে খুঁজে বের করতে হবে। মাস্টারমশাইরাও দেখা যাচ্ছে পারতপক্ষে গোপালকে ঘাঁটান না, তারই বা রহস্য কী? আর গোপাল তাকেই বা এমন করে আগলে রাখল কেন!
ছেলের দঙ্গল বিভিন্ন পথ ধরে যে-যার বাড়ির দিকে চলে গেল। রাস্তা নির্জন হয়ে এল। চৌপথি থেকে ডান হাতে বাঁক ঘুরতেই একটা নির্জন কালীবাড়ি। গতকালও লক্ষ করেছে হরি, চারদিকে মস্ত-মস্ত তেঁতুলগাছ। খুব ঝুপসি ছায়া আর নির্জনতার মধ্যে খুদে কালীবাড়িটা গাছপালার জন্য প্রায় নজরেই পড়ে না। কালী-দুগা শিব-কৃষ্ণ যা-ই হোক, ঠাকুর-দেবতার স্থান দেখলেই প্রণাম করা হরির স্বভাব। কাল ঠাহর পায়নি বলে প্রণামটা করা হয়নি। আজ ভক্তিভরে হাতজোড় করে চোখ বুজে ডবল প্রণাম ঠুকল সে মা-কালীকে, মাস্টারমশাইদের রাগ কমিয়ে দাও মা, বজ্জাত ছেলেগুলোর সুমতি দাও মা, গোপালের সঙ্গে যেন কখনও আড়ি না হয় মা, পাগলা-সাহেবের চাবুক যেন পিঠে না পড়ে মা, বাবার মনটা যেন নরম হয়ে যায় মা, আমি যেন বাড়ি ফিরে যেতে পারি মা… ইত্যাদি।
প্রণাম সেরে চোখ খুলতেই কিন্তু সে থতমত খেয়ে গেল। সামনে গোটা-চারেক হুমদো-হুঁমদো ছেলে দাঁড়িয়ে। তার ক্লাসেরই ছেলে। গোপাল এদেরই চিনিয়ে দিয়েছিল। গদাধর, অনিল, দীপঙ্কর আর রাজর্ষি।
গদাধরের চেহারা যেমন বিকট, গলার স্বরটাও পিলে চমকে দেওয়ার মতো বাজখাঁই। সে হরির থুতনিতে একটা ঠোনা মেরে সেই বাজ-ডাকা গলায় বলল, “গোপালের সঙ্গে ভাব করা হয়েছে চাঁদু? ভেবেছ পার পেয়ে যাবে? আমরা অত সোজা লোক নই হে। এখন বলো তো চাঁদু, গোপালকে কী ঘুষ দিয়ে হাত করেছ।”
ভয়ে সিঁটিয়ে গেল হরি। একটু আগে মা-কালীকে রীতিমত ভক্তির সঙ্গে ডাকাডাকি করেছে। তার এ কী পরিণাম? সে আমতা-আমতা করে বলল, “ঘুঘুষ কেন দেব? গোপালই তো বন্ধুত্ব পাতিয়েছে।”
“গোপাল বন্ধু পাতানোর ছেলে! ওকে চিনি না ভেবেছ? তা ঘুষটা ওকে না দিয়ে আমাদেরও তো দিলে পারতে। একটু ঘুষ-টুষ পেলে আমরা কি কম বন্ধুত্ব করতে জানি?”
কী জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না হরি।
গদাধরকে ঠেলে একদিকে সরিয়ে রাজর্ষি এগিয়ে এল। রাজপুত্রের মতো চেহারা। কিন্তু চোখ দুটোয় কেমন অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর দৃষ্টি। রক্ত হিম হয়ে যায়। সেই রক্ত-জল-করা চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে সে বলল, “একটা কথার জবাব দেবে?”
“কী কথা?”
“গোপাল আমাদের কথা তোমাকে কী বলেছে?”
হরি মাথা নেড়ে বলল, “কিছু বলেনি।”
“তার মানে বলবে না?”
হরি ভয় খেয়ে বলল, “তেমন কিছু বলেনি।”
“কী বলেছে তা আমরা শুনতে চাই।”
হরি বিপন্ন গলায় বলল, “সেটা তোমরা কেন গোপালকেই জিজ্ঞেস করো না।”
“সেটা আমরা বুঝব। তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি জবাব দাও।”
হরিবন্ধু হঠাৎ সাহস করে বলে ফেলল, “তোমরা কি গোপালকে ভয় পাও?”
একথায় হঠাৎ চারজনই কেমন স্থির হয়ে গেল। তারপর পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাকি করে নিল। রাজর্ষি বলল, “আমরা কাউকে ভয় পাই না। গোপালের সঙ্গে আমাদের বোঝাঁপড়া পরে হবে। এখন বলো, গোপাল তোমাকে কী বলেছে।”
চারজনের দ্বিধার ভাব দেখে হরিবন্ধুর আর সন্দেহ রইল না যে, মুখে যতই বারফাট্টাই করুক, এরা গোপালকে ভয় পায়। এটা বুঝতে পেরে তার বুকে যথেষ্ট সাহস এল। সে বুক চিতিয়ে বলল, “আমি বলব না।”
রাজর্ষি আর গদাধর এই জবাবে খুবই যেন অবাক হয়ে গেল। কেমন যেন দ্বিধার ভাবও তাদের হাবভাবে। রাজর্ষি বলল, “আমার সম্পর্কে তোমাকে ও কিছু বলেছে?”
“বলতে পারে।”
“কী বলেছে সেটা আমি জানতে চাই।”
“জেনে কী করবে? মারবে গোপালকে?”
“সেটা ভেবে দেখব।”
হরি ঘুরে দাঁড়িয়ে বাড়িমুখো হাঁটা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, “তা হলে বাড়ি গিয়ে ভাবো গে যাও। কাল তোমার প্রশ্নের জবাব দেব।”
আশ্চর্যের বিষয়, ছেলেগুলো তার পিছু নিল না বা শাসাল না, মারা তো দূরের কথা। একটু এগিয়ে গিয়ে একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে হরি দেখল, তেঁতুলতলার ছায়ায় চারটে ছেলে এখনও ভূতের মতো দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। গোপাল বলেছিল, ওই চারজনের তিনটে ডাকাত, একটা খুনে। হতেও পারে। তবে আপাতত চারজনের মাথাতেই যেন ধুলোপড়া পড়েছে।
হরি যখন বাড়ি ফিরল, তখন বেলা মরে এসেছে। সে ঘরে ঢুকতেই জগুরামের বউ ঝুমরি একটা কেরোসিনের টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে ঘরে দিয়ে গেল। হরি বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আসতেই ঝুমরি মস্ত এক বাটিতে বিশাল এক তাল ছাতুমাখা নিয়ে এল।
ছাতু হরি কখনও খায়নি। দেখেই তার খিদে উবে গেল। সে বলল, “ওসব আমি খাই না। নিয়ে যাও।”
ঝুমরি বড় একটা কথা কয় না। এবারও কিছু বলল না। টেবিলের ওপর ছাতুর বাটির পাশে এক গ্লাস জল গড়িয়ে রেখে দিয়ে চলে গেল।
ছাতু দেখে যতই অনিচ্ছে হোক, পেটে তার সাঙ্ঘাতিক খিদে। এখানকার জল-হাওয়া ভাল বলেই সে শুনেছে। তাই দোনোমোনো করে সে ছাতুর তাল থেকে একটু খুঁটে মুখে তুলল। মনে হচ্ছে আচারের তেল এবং আরও দু-একটা অদ্ভুত মশলা দিয়ে মাখা। টক, ঝাল, নোনতা স্বাদটাও বেশ ভাল। নিজের অজান্তেই আনমনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে হরি ছাতুর তাল থেকে ভেঙে-ভেঙে খেতে লাগল।