হরি গম্ভীর মুখে বলল, “আমার কথা আর চিন্তা কোরো না। আমাকে ভুলে যাও গোবিন্দদা।”
গাড়ির সময় হয়ে গিয়েছিল বলে কথা আর গড়াল না। গোবিন্দ রওনা হয়ে যাওয়ার পর স্নান-খাওয়া সেরে দুরুদুরু বুকে স্কুলে রওনা হল হরি।
ক্লাসে ঢুকতেই বাঁ দিকের থার্ড বেঞ্চ থেকে গোপাল তাকে ডাকল, “এই যে ভাই, এখানে এসে বোসো। তোমার জন্য জায়গা রেখেছি।”
হরি গিয়ে ঝুপ করে গোপালের পাশে বসে পড়ল। আর বসবার পরেই বুঝল, ক্লাসটা কেমন যেন নিশ্ৰুপ হয়ে গেল। সকলেই তার দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না বা করছে না।
গোপাল মৃদু স্বরে বলল, “ভয় পেও না। আজ হয়তো ওরা তোমাকে কিছু করবে না।”
“কেন, করবে না কেন?”
“ওরা বোধহয় কালকের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত।”
আশ্চর্যের বিষয়, রাস্তবিকই আজ দুষ্টু ছেলেগুলো হরির দিকে একেবারেই মনোযোগ দিচ্ছিল না। নিজেদের মধ্যে চেঁচামেচি, ঝগড়া-মারামাবি করছিল বটে, কিন্তু হরিকে ‘রাঙামুলো’ বলে ডাকল না একবারও, কিল চড় ঘুসিও কেউ দিল না।
গোপাল মৃদু স্বরে ছেলেদের চিনিয়ে দিচ্ছিল, “লাস্ট বেঞ্চের বাঁ দিকের কোণে যে ছেলেটা বসে আছে, তাকে ভাল করে দেখে নাও। ও হল ভজন। ডেনজারাস ছেলে। দুর্দান্ত ফুটবল খেলোয়াড় আর তেমনি মারকুট্টা। ওপাশের ফোর্থ বেঞ্চে বসে আছে তিনটে ছেলে। ওদের বলা হয় থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। গদাধর, অনিল আর দীপঙ্কর। লোকে বলে, ওরা একটা ডাকাতের দলে আছে। আমাদের পিছনের বেঞ্চে ডান দিকের কোণে বসে আছে রাজর্ষি। চেহারাটা খুব লালটু। দারুণ বড়লোকের ছেলে। ও নাকি ওদের একজন চাকরকে বন্দুকের গুলিতে জখম করেছিল বেয়াদবির জন্য। খুব সাংঘাতিক ছেলে। ও-পাশের সেকেণ্ড বেঞ্চে দ্যাখো, কোণের ওই যে নীল শার্ট আর তার পাশে হলুদ গেঞ্জি পরা দু’জন, ওদের নাম পার্থ আর শিবশঙ্কর। পার্থ খুব ভাল ওয়েট লিফটার আর শিবু কারাটিকা। ওই দু’জনের মতো পাজি খুব কম আছে। এদের আপাতত চিনে রাখো। সাধ্যমতো এড়িয়ে চোলো।”
হরি সব ক’জনকেই চিনতে পারল। এরাই কাল তার ওপর অত্যাচার করেছে সবচেয়ে বেশি।
সে গোপালের দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু ওরা আজ আমাকে ছেড়ে দিচ্ছে কেন বলো তো! তোমার জন্য?”
গোপাল মাথা নেড়ে বলল, “না, না। আমার জন্য কেন হবে?”
হরি তবু গোপালকে ভাল করে একবার দেখল। অসাধারণ কিছুই নেই গোপালের মধ্যে। কালো, ছিপছিপে, লম্বাটে গড়ন। গায়ে এমন কিছু আহামরি জোর থাকার কথা নয়। মুখোনাও নিপাট ভালমানুষের মতোই। ষণ্ডাগুণ্ডা বলে মনে হয় না। তবে তার চোখ দুখানা বেশ তীক্ষ্ণ।
ক্লাস শুরু হওয়ার পর হরি লক্ষ করল, মাস্টারমশাইরাও কেন যেন গোপালকে এড়িয়ে যান। একমাত্র হেডস্যারের ভূগোল ক্লাস আর জাহ্নবীবাবুর অঙ্ক ক্লাস ছাড়া আর কোনও ক্লাসে কোনও মাস্টারমশাই গোপালকে কোনও. প্রশ্ন করলেন না।
হরি আর-একটা জিনিসও লক্ষ করল। এ ক্লাসের সব ছেলেই বেশ বড়-বড়। বেশির ভাগেরই বয়স পনেরো-ষোলোলা থেকে উনিশ কুড়ি। বোঝা যায় যে, এরা বহুবার গাড়ু মেরে ক্লাস সেভেনে উঠেছে। গোপালেরও বয়স সতেরো-আঠারো হরে। দুই ক্লাসের ফাঁকে একবার সে গোপালকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি ভাই অনেকবার ফেল করেছ?”
গোপাল মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “না, তবে লেখাপড়া শুরু করতেই আমার অনেক দেরি হয়েছে।”
“কেন?”
সে অনেক কথা। তবে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম! অনেক দিন পালিয়ে-বেড়িয়ে থাকার ফলে পড়াশুনো হয়নি।”
“কেন পালিয়েছিলে?”
“বাড়িতে ভাল লাগে না। পৃথিবীটা কী বিশাল, আর বাড়িটা কত ছোট।”
আজ টিফিন পিরিয়ডে হরি আর গোপাল একসঙ্গে বেরোল। জামতলায় একজন চিনেবাদামওলা বসেছিল। তার কাছ থেকে দু’জনে বাদাম কিনে গাছের ছায়ায় বসে বসে গল্প করল। গোপাল নিজে বেশি কথা বলল না, বরং হরিকে প্রশ্ন করে করে তার বাড়ির কথা আর এখানে
আসার ইতিহাস সব জেনে নিল। হরি বলল, “ও, ভাল কথা, আমাদের বাড়িটার নাম কুসুমকুঞ্জ নয়, গ্রিন ভ্যালি।”
গোপাল হাসল; বলল, “জানি। কালই খোঁজ নিয়েছি। খুব ভাল আতা হয় ওবাড়িতে। ভাল জাতের ল্যাংড়া আমও ফলে। একবার আম চুরি করতে গিয়ে ওই জগুরামের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম।”
“বটে? তারপর কী হল?”
“জগুরাম কুস্তিগির ছিল, তা জানো?”
“না। তবে ওরকমই চেহারা। তোমাকে মারল নাকি?” গোপাল একটু হেসে বলল, “মারতেই চেয়েছিল। তবে পারেনি।”
“কেন পারেনি?”
“পাগলা-সাহেব এসে পড়ল যে!”
“পাগলা-সাহেব কে বলল তো? কালও একজন বলছিল, সে নাকি সাদা ঘোড়ায় চেপে একজন সাহেবকে যেতে দেখেছে।”
“ঠিকই দেখেছে।”
“পাগলা-সাহেব কি সত্যিই পাগল?”
“তা কে জানে! লোকে বলে পাগলা-সাহেব, আমরাও তাই বলি। তবে…”
“তবে কী?”
“পাগলা-সাহেবকে কিন্তু সবাই দেখতে পায় না। কেউ-কেউ পায়।”
“তার মানে কী?”
গোপাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজায় কথাটা আর এগোল না।
টিফিনের পরের ঘন্টাগুলোও আজ বেশ শান্তিতেই কেটে গেল। শুধু ইতিহাসের ক্লাসে আকবরের ছেলের নাম বলতে না পারায় হরিবন্ধুকে একটি মোলায়েম কানমলা খেতে হল। তা সেটা গায়ে না মাখলেও চলে। মারধোর তার কাছে কিছুই নয়।
ছুটির ঘন্টা বাজবার একটু আগে গোপাল বলল, “আজও তোমাকে একটু এগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নোয়াপাড়ার সঙ্গে আজ একটা কাবাডি ম্যাচ আছে।”