হুকুম হল, “গোরু সেজে ঘাস খাও।”
তা-ই করতে হল হরিকে।
তারপর হুকুম হল, “চোখের পাতা একবারও না ফেলে পাঁচ মিনিট চেয়ে থাকো।”
তা-ই করতে হল।
ফের হুকুম, “এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সারা মাঠ চক্কর দাও।”
হরি তাও করল।
যখন ছাড়া পেল, তখন সে হেঁদিয়ে পড়েছে।
ছুটির পর যখন ক্লাসের ছেলেরা দুদ্দাড় করে বেরোচ্ছিল, তখন হরি বুদ্ধি করে তাদের সঙ্গে বেরোনোর চেষ্টা করল না, ক্লাসেই চুপ করে বসে রইল। কারণ ছেলেগুলো রাস্তায় তার ওপর ফের হামলা করতে পারে। স্কুল ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর সে গুটিগুটি বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরল।
কিছুদূর হাঁটার পরই হরি একটা অস্বস্তি বোধ করছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ তার পিছু নিয়েছে। কেউ পিছু নিলে বা তাকিয়ে থাকলে মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে তা ধরা পড়েই, এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু টের ঠিকই পাওয়া যায়। হরিও পেল। চৌপথিতে ডান হাতে মোড় নিতে গিয়েই সে ছেলেটাকে লক্ষ করল। কালো, লম্বামতো। সে ফিরে তাকাতেই ছেলেটা হাত তুলে থামতে ইশারা করল।
হরি আর দাঁড়াল না। হাঁটা ছেড়ে ছুটতে শুরু করে দিল। পিছন থেকে ছেলেটা ডাকল, “এই খোকা, শোনো, শোনো। ভয় নেই, আমি ওদের দলের নই।”
হরি দাঁড়াল, সন্দিহান চোখে ছেলেটার দিকে চেয়ে রইল।
ছেলেটা কাছে এসে বলল, “আমার নাম গোপাল। আমি তোমার সঙ্গেই এক ক্লাসে পড়ি। আজ তোমাকে ওরা যা করছিল, দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তোমার ভাই, ভীষণ সহ্যশক্তি।”
হরি স্বস্তির খাস ছেড়ে বলল, “ওরা ওরকম কেন বলো তো!”
গোপাল মৃদু একটু হেসে বলল, “এখানে ওরকম সব ছেলেই সংখ্যায় বেশি। তুমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলো না! পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম কয়েকটা দিন যা একটু কষ্ট। নতুন ছেলে এলেই এসব হয়।”
দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
গোপাল জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় থাকো?”
“কাঠগোলার দুখিরামবাবুর বাড়িতে।”
“সেটা কোথায়?”
“এই দিকে।” বলে হাত তুলে রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে হরি বলল, “রাস্তার শেষ দিকটায়। বাগান-ঘেরা বাড়ি।”
গোপাল বলল, “ওটা হল সাহেবপাড়া। এককালে সাহেবরা থাকত। এখন আর ও-পাড়ায় কেউ থাকে না। আমরা মাঝে-মাঝে পেয়ারা লিচু পাড়তে যাই। তোমাদের বাড়িটার কোনও নাম আছে?”
“খেয়াল করিনি তো!”
“কুসুমকুঞ্জ নয় তো! শুনেছিলাম কে এক বড়লোক কুসুমকুঞ্জ কিনে নিয়েছে।”
“হতে পারে।”
“যদি কুসুমকুঞ্জ হয়, তবে…”
“তবে কী?”
“না, বাড়িটার তেমন সুনাম নেই কিনা।”
“সুনাম নেই কেন? ভূত আছে নাকি?”
“কে জানে বাবা। এ-পাড়ার সব বাড়িই পুরনো। ভূত থাকতেই পারে। আমার ভীষণ ভূতের ভয়। তোমার?”
“আমারও।”
সামনের চৌপথিতে এসে গোপাল বলল, “আমি এবার বাঁ দিকে যাব। তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে বেশ হল। কাল থেকে তুমি আমার পাশে বসবে। বাঁ দিকে থার্ড বেঞ্চ।”
হরি মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”
একজন বন্ধু পাওয়ায় হরির বেশ ভালই লাগছিল। গোপালের কথা ভাবতে ভাবতেই সে দুখিরামবাবুর বাড়ির ফটকে এসে পৌঁছল। ফটকের দু’ধারে দুটো মস্ত থাম। দুটোর গায়েই লতা বেয়ে উঠে ঢেকে ফেলেছে প্রায়। বাঁ দিকের থামের গায়ে একটা শ্বেতপাথরের ফলক লতার আড়ালে ঢেকে গেছে। হরি লতাপাতা সরিয়ে বিবর্ণ ফলকটা লক্ষ করল। অক্ষরগুলো প্রায় মুছে গেছে, তবু পড়া যায়। হরি দেখে নিশ্চিন্ত হল যে, বাড়িটার নাম কুসুমকুঞ্জ নয়। এমনকী বাংলা নামই নয়। ইংরিজিতে লেখা ‘গ্রিন ভ্যালি।’
৩. পরদিন সকালে গোবিন্দ
পরদিন সকালে গোবিন্দ চলে গেল। যাওয়ার আগে বলল, “আমি জায়গাটা বিশেষ ভাল বুঝছি না বাপু। বড় যেন কেমন-কেমন। তা বড়বাবুকে গিয়ে আমি বলব’খন যেন এখানে তোমাকে আর না রাখেন। ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যাওয়া ভাল।”
একথায় হরির চোখে জল এসে গেল। বাবা যে তাকে একরকম বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, একথাটা তার অল্প বুদ্ধিতেও বুঝতে কষ্ট হয়নি। অভিমানে তার বুক ভারী হয়ে উঠল। সে মাথা নেড়ে বলল, “না গোবিন্দদা, এ-জায়গা ছেড়ে আমি যাব না। মরি তো মরব।”
“বালাই ষাট, মরবে কেন?” বলে গোবিন্দ তার পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে বলল, “চারদিকে লক্ষ রেখো। রাত্রিবেলা টর্চবাতি আর লাঠি হাতের কাছে রাখবে। ঠক-জোচ্চোরদের পাল্লায় পোড়ো না। পেট ভরে খেও। আর পাগলা-সাহেবটাকে দেখলে সেলাম কোরো।”
হরি অবাক হয়ে বলল, “পাগলা-সাহেব! সে আবার কে?”
গোবিন্দ হাত উলটে বলল, “কী করে তা বলি! দুপুরে একটু হাঁটাহাঁটি করতে পথে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দেখি একটা সাদা ঘোড়ায় চেপে এক সাহেব যাচ্ছে। হঠাৎ আমার দিকে কটমট করে চেয়ে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে পেল্লায় ধমক দিল, ‘অ্যাও, সেলাম কাহে নাহি কিয়া? আমি তো ভয়ে মূর্ছা যাই আর কি। চিচি করে কী বললাম, সাহেব তা বুঝল না। হাতের চাবুকটা তুলে সপাং করে চালাল। ভাগ্যিস লাগেনি। পড়ি কি মড়ি করে পালিয়ে বাঁচি। ফিরে এসে জগুরামকে সব বলছিলাম। কিন্তু ব্যাটা এমন পাষণ্ড যে, একটা জবাবও দিল না। শুধু রাক্ষুসে চোখে একবার চেয়ে যেমন বাগানের ঘাস নিড়ড়াচ্ছিল তেমনি নিছড়াতে লাগল। একটা বিড়ি দিতে গেলুম, নিল না। দুটো মন-ভেজানো কথা বললুম, কানেই তুলল না। দুর্গা, দুর্গা, কী হবে কে জানে। আমি হলে বাপু আর এক দণ্ডও এখানে থাকতুম না। তোমার জন্য বড় চিন্তা রইল।”