আধমাইল হেঁটে সে যখন স্কুলের দরজায় পৌঁছল তখন তার বুকটা দমে গেল। এরকম নিরাপদ স্কুলবাড়ি সে দ্যাখেনি। সাদা একটা দোতলা ব্যারাকবাড়ি। খুব উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। দেখলে স্কুল নয়, জেলখানা বলে মনে হয়। হরি যখন স্কুলে ঢুকছে, তখন স্কুল বসবার ঘণ্টা বাজছিল। ঘণ্টার শব্দটাও যেন কেমন, গম্ভীর, মন উদাস করে দেয়। স্কুলের মধ্যে ছেলেদের কোনও হইহই নেই। সব শান্ত, ঠাণ্ডা।
খুব ভয়ে-ভয়ে সে দেউড়ি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল। একটা বজ্রগম্ভীর গলা বলে উঠল, “কী চাই?”
হরি সভয়ে দ্যাখে ব্যারাকবাড়ির একতলার বারান্দার কোণে, ফটকের মুখেই এক বিশাল চেহারার ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, রংটি ঘোর কালো, হাতে বেত, চোখে প্রখর দৃষ্টি।
কাঁপা গলায় হরি বলল, “আমি হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করব।”
ভদ্রলোক হাতের বেতখানা তুলে তাঁর পিছনের দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “ওই ঘরে গিয়ে বোসো।”
হরি ভয়ে-ভয়ে বারান্দায় উঠল এবং ভদ্রলোকের পাশ দিয়ে একটা পিঁপড়ের মতো গলে গিয়ে ঘরটায় ঢুকল। ঘরে একটা সবুজ রেকসিনে-মোড়া ডেস্ক আর গুটিকয় চেয়ার, কয়েকটা আলমারি, আলমারির মাথায় গ্লোব, ফাঁইল ক্যাবিনেট, হাজিরা-খাতা, নোটিসবই সব রয়েছে। হরি বসল না। হেডস্যারের ঘরে বসতে নেই, সে জানে। সে একটু কোণের দিকে সরে দাঁড়িয়ে রইল।
স্কুল বসবার দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে মাস্টারমশাইরা অনেকটা মিলিটারিদের মতো গটমটে পায়ে একে-একে ঢুকে একটা করে হাজিরা-খাতা তুলে নিয়ে ক্লাসমুখে চলে যেতে লাগলেন। এরকম স্বাস্থ্যবান সব মাস্টারমশাই হরি কদাচিৎ দেখেছে। প্রত্যেকেরই বেশ চওড়া কব্জি, বিশাল-বিশাল বুকের ছাতি, কারও মুখে হাসির লেশমাত্র নেই, আর প্রত্যেকের চোখের দৃষ্টিই ভয়ঙ্কর।
মাস্টারমশাইরা ক্লাসে চলে যাওয়ার পর সেই বেতওয়ালা ভদ্রলোক
এসে ঘরে ঢুকলেন। নিজের চেয়ারে বসে তার দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি দুখিরামবাবুর চিঠি নিয়ে এসেছে, না? দাও দেখি চিঠিখানা।”
হরি চিঠিটা দিল। “টাকা এনেছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“যাও, এর পাশের ঘরেই অফিস। ভর্তি হয়ে সোজা দোতলায় উঠে বাঁ দিকের প্রথম ঘরে চলে যাবে। সেটাই ক্লাস সেভেন ডি সেকশন।”
“আজ্ঞে।”
ভর্তি হতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। একজন একশো বছর বয়সী বুড়ো লোক টাকা গুনে নিয়ে একটা লেজারে তার নামধাম লিখল। একখানা রসিদ আর বুকলিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ক্লাসে চলে যাও।”
দোতলার ক্লাসঘরে তখন টকটকে ফর্সা ব্যায়ামবীরের মতো চেহারার এক মাস্টারমশাই ইংরিজির ক্লাস নিচ্ছিলেন। সে দরজায় দাঁড়াতেই কটমট করে তাকিয়ে বললেন, “বাঁ দিকে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ো।”
ক্লাসে জুনা-ত্রিশ ছেলে। প্রত্যেকেই নিশ্চপ। মাস্টারমশাই একজন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, “বিউটিফুল বানান কী?”
“বি ইউ…”
“বারান্দায় কান ধরে নিলডাউন।” ছেলেটা নিলডাউন হল। “বলাই, জাঁকজমক ইংরিজি কী?”
“প… প… প….”
“পাঁচ বেত। এদিকে এসো।”
পাঁচ ঘা বেতের শব্দ হরি চোখ বুজে শুনল। কী শব্দ রে বাবা। অন্য ছেলেকে মারা হচ্ছে, আর হরি যেন নিজের শরীরে টের পাচ্ছে।
ক্লাসের ছেলেদেরও হরি লক্ষ করল। এ-ক্লাসে সব ছেলেই বেশ ধেড়ে এবং তাগড়াই চেহারার। কারও বয়সই হরির চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই হবে। কেমন যেন বন্য, ক্ষুধার্ত দৃষ্টি সকলের চোখে।
ছেলেগুলো যে সুবিধের নয়, তা বোঝা গেল মাস্টারমশাই প্রথম পিরিয়ড পড়িয়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তিনটে মুশকো চেহারার ছেলে তিনদিক থেকে গদাম গদাম করে এসে লাফিয়ে পড়ল তার ওপর। দু’জন দুটো হাত চেপে ধরল, একজন তার চুলের মুঠি ধরে মুখটা তুলে বলল, “দেখি, দেখি চাঁদ, কোন্ গগন থেকে উদয় হলে!”
আকস্মিক এই আক্রমণে হরি এমন ঘাবড়ে গেল যে, তার মুখে কথাই ফুটল না। সভয়ে চেয়ে রইল শুধু। যে ছেলেটা চুল ধরেছিল, সে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “বোবা নাকি হে? কিন্তু বোবারও যে এখানে মারের চোটে বুলি ফোটে তা জানো?”
পিছন থেকে কে যেন ঘাড়ে একখানা রদ্দা মেরে বলল, “না রে, বেশ ঘাড়ে-গদানে আছে। ভাল পানচিং ব্যাগ হতে পারবে।”
সকলে হিহি করে হাসল।
এই স্কুলে মাস্টারমশাইরা ক্লাসে আসতে মোটেই দেরি করেন না। বারান্দায় গটমটে জুতোর শব্দ পেয়েই ছেলে তিনটে তাকে ছেড়ে দিল। একজন শুধু চাপা স্বরে বলল, “নালিশ করলে আস্ত রাখব না, মনে থাকে যেন!”
রাগে দুঃখে হরির চোখে জল এসে গিয়েছিল বটে, কিন্তু সে নালিশও করল না।
দ্বিতীয় পিরিয়ডে বাংলা ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন ঠিক মহিষাসুরের মতো চেহারার এক মাস্টারমশাই। সন্ধি সমাস প্রত্যয়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর হাতের বেতও ফোঁসফোঁস করতে লাগল। সাতজন বেত খেল, তিনজন নিডাউন হল, চারজনের মাথায় পড়ল ডাস্টারের ঘা।
দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হতেই আবার গোটা চারেক ছেলে উঠে এসে ঘিরে ফেলল হরিকে।
“বাঃ, বেশ রাঙামুলোর মতো চেহারাটি তো তোমার ভাই। কিন্তু এ চেহারা কি রাখতে পারবে? শুকিয়ে যে হকি হয়ে যাবে বাছাধন?”
“দেখি তো ভাই তোমার হাতের লেখা কেমন। খাতায় লেখো তো ‘আমি একটি গাধা। লেখো, লেখো-.”
“কাতুকুতু তোমার কেমন লাগে থোকা? ভাল নয়?”
“জিভ ভেঙাতে পারো? একটু ভেঙাও তো!”
প্রতি পিরিয়ডের পরই এরকম চলতে লাগল। টিফিন পিরিয়ডে তাকে একরকম ধরেবেঁধেই স্কুলের পাশের মাঠটায় নামানো হল।