হরিবন্ধু বলল, “কিসের অসুবিধে?”
“গণ্ডগোল আছে।”
“কিসের গণ্ডগোল?”
“কাজটা ভাল হল না।”
“কোন কাজটা?”
“এই যে তোমাকে এখানে পাঠানো হল, একাজটা ভাল হয়নি। বাড়িটা কেমন যেন অলুক্ষুনে ঠেকছে।”
হরিবন্ধুর কাছে গোটা ব্যাপারটাই অলুক্ষুনে। মা বাবা-ভাই-বোন এবং সর্বোপরি ঠাকুমাকে ছেড়ে এই পাণ্ডববর্জিত দেশে আসতে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। ঠাকুমার গায়ের সঙ্গে লেটে না শুলে তার ঘুম আসে না। মা ভাত বেড়ে না দিলে খেয়ে তার পেট ভরে না। সে একটু বোকা বলেই বোধহয় তার ছোট ভাই-বোনেরা তাকে ভীষণ ভালবাসে। গাছ থেকে আম, জাম, কুল পেড়ে দিয়ে সে-ও তো ওদের খুশি করতে ভালবাসে। গাছকে মাটি থেকে উপড়ে ফেললে গাছের কেমন অনুভূতি হয়, তা হরি জানে না বটে, কিন্তু চলে আসার সময়ে তার মনে হচ্ছিল যে, তাকে কেউ যেন মাটি থেকে শিকড়সমেত উপড়ে ফেলছে। এই যাত্রাই তার শেষ যাত্রা। বাড়ি থেকে তো একরকম তাড়িয়েই দেওয়া হল তাকে। সে কি আর ফিরে যেতে পারবে কোনওদিন?
যাই হোক, বাক্স-বিছানা নিয়ে নামতেই একজন গম্ভীরমতো দরোয়ান এসে বিনা প্রশ্নে ফটক খুলে দিল। একটিও কথা না বলে সে গটগট করে হেঁটে গিয়ে নীচুতলার একখানা ঘর খুলে দিয়ে চলে গেল। তার হাবভাব দেখে হরির একটু কেমন-কেমন লাগছিল। ঠিক যেন মানুষ নয়, যন্ত্রমানব। ভাবলেশহীন পাথুরে মুখ, বিশাল মজবুত চেহারার এই লোকটাই যে এখানে তার খবরদারি করবে এটা ভেবে তার মনটা কিন্তু-কিন্তু করতেই লাগল।
দরোয়ান যেমনই হোক, ঘরখানা কিন্তু ভাল। বেশ খোলামেলা। জানলা খুললেই সবুজ গাছপালা আর বাগান দেখা যায়। জানলা বেয়ে কেঁপে উঠেছে বোগেনভেলিয়ার পুষ্পিত ডালপালা। ঘরে বেশ আলো-হাওয়া আছে।
গোবিন্দ খুব খুঁতখুঁতে চোখে চারদিকটা দেখে নিল। ভিতরদিককার দু’খানা বন্ধ দরজা ঠেলেঠুলে দেখল। জানলার পাল্লা, গ্রিল, দরজার কাঠ পরীক্ষা করল। বাথরুমে ঢুকে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে নিল। তারপর বলল, “বাড়িখানা পুরনো হলেও মজবুত। ব্যবস্থাও যা দেখছি ভালই। তবে বলছি বাপু, এবাড়ি আমার ভাল ঠেকছে না।”
হরি মন খারাপ করে জানলার ধারে বসে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। বাড়ির কথা ভেবে তার চোখ ভরে জল আসছে। গোবিন্দর কথা তার কানেও গেল না। দুখিরামবাবু একখানা চিঠি দিয়ে দিয়েছেন। সেখানা নিয়ে আজই স্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আজই স্কুলে ভর্তি করে নেওয়া হবে তাকে। তারপর এখানেই থেকে যেতে হবে তাকে। কতকাল কে জানে।
গোবিন্দ তার অবস্থা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভেবে আর কী করবে। আজ আবার ইস্কুলে যেতে হবে। চানটান করে তৈরি হও। আমি একটু দেখিগে ব্যাটা প্যাঁচামুখো দরোয়ানটা রান্নাবান্নার কী বিলি ব্যবস্থা করল।”
হরি চোখের জল মুছে উঠল এবং স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগল। ফলে কাল সকালের গাড়িতে গোবিন্দদাও ফিরে যাবে। তারপর
সে একদম একা। ভাবতেই বুকটা হাহাকার করে উঠল তার।
ফটকের পাশেই আউট-হাউস। সেখানে দরোয়ান জগুরাম থাকে। গোবিন্দ গিয়ে খুব তেজী গলায় ডাকল, “জগুরাম! বলি জগু আছিস নাকি রে?”
দরজা খুলে বিশাল চেহারার জগুরাম দেখা দিল। চোখে রক্তজল করা দৃষ্টি। সেই সাঙ্ঘাতিক চোখে সে গোবিন্দকে নীরবে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
গোবিন্দর গলা তিন পদ নেমে গেল হঠাৎ। বিগলিত একটু হেসে সে বলল, “এই যে জগুভায়া, আপনার কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। তা ইয়ে, খাবারটাবার কি কিছু মিলেগা? এই ধরো চাট্টি ভাত, একটু ডাল…”
জগুরাম সেইরকমই নিষ্কম্প চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খুবই মৃদু স্বরে বলল, মিলেগা।”
“তথাস্তু।” বলে গোবিন্দ পালিয়ে বাঁচল, মনে-মনে ভাবল, ব্যাটা একেবারেই পাষণ্ড, আর একটুক্ষণ ওরকম চেয়ে থাকলে ভস্মই করে দিত আমাকে।
ফটকের বাইরে এসে গোবিন্দ চারধারটা ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল। পাড়াটা এতই নির্জন যে, এই সকালবেলাতেও একটিও মানুষ নেই পথে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব বাগানে ঘেরা নির্জন বাড়ি। কোথাও মানুষ তো থাকে বলে মনে হয় না। দুখিরামবাবুর বাড়ির দু’পাশে যে দুটি বাড়ি আছে সেগুলোতে দরোয়ানও নেই। ফটকে জংধরা তালা ঝুলছে। ভিতরের বাগান আগাছায় ছেয়ে গেছে। বাড়ির দেওয়ালে শ্যাওলা ধরেছে।
২. স্নান করে এসে হরি
স্নান করে এসে হরি জামাপ্যান্ট পরে চুল আঁচড়াচ্ছিল, এমন সময় ঘোমটা-টানা একটা বউ থালায় ভাত ডাল তরকারি বেড়ে নিয়ে এসে কোণের টেবিলটায় রাখল।
থালায় ভাতের পরিমাণ দেখে হরি আঁতকে উঠে বলল, “আমি অত ভাত খেতে পারব না। কমিয়ে আনুন।”
বউটা একথার কোনও জবাব দিল না। নিঃশব্দে চলে গেল।
ভাল জ্বালা হল হরির। এই নির্জন বাড়িতে কথা বলার মতো লোক বলতে ওই দু’জন। দরোয়ানটা গোমড়ামুখো, বউটাও যদি তাই হয় তো মহা মুশকিল।
ভাতের রুচিও ছিল না হরির। স্কুলের চিন্তায় তার পেটে পাক দিচ্ছে। শুনেছে, খুবই কড়া স্কুল। তার ওপর বাড়ির জন্য মন খারাপ তো আছেই। ফেলে-ছড়িয়ে খানিকটা ভাত খেয়ে সে উঠে পড়ল। গোবিন্দদা এখনও ফেরেনি। সহজে ফিরবেও না। দারুণ আড্ডাবাজ লোক। তার
জন্য অপেক্ষা না করে দুখিরামবাবুর চিঠি আর স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা পকেটে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। ঘরটা ভোলা রইল। থাক, দরোয়ান আছে, আর তা ছাড়া তার চুরি যাওয়ার মতো তেমন কিছু নেইও।