মোলায়েম গলা তার দিকে ফিরে বলল, “এদের তুলনায় তোমার প্রতি আমরা কিন্তু যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহারই করেছি। তাই না?”
রাগে দুঃখে হরির মুখে কথা ফুটল না।
মোলায়েম গলা বলল, “আরও দেখবে? এসো। এখানে অনেক ঘর আছে।”
লোকটা আর-একটা ঘর খুলে দিয়ে বলল, “এরা বাপব্যাটা তোমাদের উদ্ধার করতে এসেছিল।
হরি দেখল, মেঝেতে আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়ে পড়ে আছে ঝিকু-সদার। ঘরের এক কোণে মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে গোপাল। তার মাথায় এখনও ব্যাণ্ডেজ। জ্ঞান নেই কারও।
মোলায়েম গলা বলল, “এরা বাপব্যাটায় পাগলা-সাহেব সেজে সাদা ঘোড়ায় চেপে এতকাল ধরে লোককে বোকা বানিয়ে এসেছে। আমাদেরও বানিয়েছিল!”
হরি অস্ফুট গলায় শুধু বলল, “কিন্তু গোপালের যে জ্বর!”
“জানি। তবে জ্বর তো আর মরে যাওয়ার পর থাকবে না। তখন গা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।”
“কিন্তু আপনি এদের কেন মারবেন?”
“আমার কাছে মানুষ আর পিঁপড়েয় তফাত নেই। বাঁচিয়ে রাখলে অনেক ঝামেলা। শত্রুর গোড়া থেকে যাবে, সাক্ষী থেকে যাবে। আমি যখন যা করি তার চিহ্ন মুছে ফেলি। তবে যদি কবরটা দেখিয়ে দিতে পারো তা হলে অন্য কথা।”
“কী কথা?”
“কবরটার সন্ধান দিলে তোমাকে পুরস্কার দেব বলেছিলাম। আমি বাজে কথা বলি না। তুমি এদের প্রাণ পুরস্কার হিসেবে পেতে পারো।”
লোকটার দিকে অন্ধকারে হরি চেয়ে রইল। মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু লোকটা মানুষ না দানব সে বিষয়ে সন্দেহ হতে লাগল হরির।
হঠাৎ তার মাথায় কী দুর্বুদ্ধি চাপল কে জানে, হরি তার হাতকড়া-পরা হাত দু’খানা তুলে আচমকা লোকটার কপালে বসিয়ে দিল।
অন্তত হরি ভেবেছিল তাই। কিন্তু অতিশয় ধূর্ত লোকটা কী করে যেন চোখের পলকে টের পেয়ে একটা হাত তুলে খপ করে হরির হাত ধরে ফেলল, যেভাবে সাপুড়ে বিষাক্ত সাপকে ধরে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই অন্ধকার আনাচকানাচ থেকে আট-দশজন লোক ছুটে এল।
হরির মাথার আগুনটা নিবল না। সে হাত নাড়তে না পেরে ডান পায়ে একটা লাথি ছুঁড়ল। লাথিটা শূন্যে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল।
তিন-চারজন লোক পিছন থেকে ধরল হরিকে।
হরি বুঝল, এই খুনিরা এরপর তাকে আর আস্ত রাখবে না। মরতেই যদি হয় তো লড়ে মরাই ভাল।
হরি আর বাছবিচার করল না। অন্ধকারে শিকলে বাঁধা হাত আর দু’খানা মুক্ত পা নিয়ে সে যথেচ্ছ চালাতে লাগল চারদিকে। অবশ্য চারদিক থেকে মারগুলোও ফিরে আসতে লাগল।
হরি মার খেতে-খেতেও হাতকড়া পরা হাত দুটো দিয়ে পট করে জড়িয়ে ধরল মোলায়েম কণ্ঠস্বরের গলাটা। তারপর সকলে মিলে একটা বিশাল মানুষের পিণ্ড পাকিয়ে গেল।
সেই পিণ্ডটা গড়াতে লাগল। গড়াতে লাগল। একটু ঢালু জমি না? গড়াতে গড়াতে ঢালু বেয়ে নেমে যেতে লাগল সবাই।
কে যেন চেঁচাল, “সামালকে!”
কিন্তু সামলানো যাচ্ছিল না। পিছল ঢালু বেয়ে তারা সকলে পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি অবস্থায় অসহায়ভাবে গড়িয়ে যেতে লাগল। অন্ধকার রন্ধ্রপথটা যে কতদূর গেছে!
ঝং করে বিকট একটা শব্দ হল।
কিসে এসে ঠেকল তারা?
ধীরে-ধীরে লোকগুলো উঠে বসল। চারদিকে তাকাতে লাগল। হরি নির্নিমেষ চেয়ে ছিল কাঠের চৌকো দরজাটার দিকে। দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। না, বেশি নয়। সামান্যই।
আর সেই ফাঁক দিয়ে এক অদ্ভুত নরম, মায়াবী নীল আলো এসে ভরে দিল সুড়ঙ্গ।
মোলায়েম গলা অবাক হয়ে বলল, “এ কী?”
হরিবন্ধু হতাশায় ভরা গলায় বলল, “কবর। পাগলা-সাহেবের কবর।”
দরজাটা ঝটাং করে খুলে দিল মোলায়েম গলার লোকটা।
নীচে সেই গোল ঘর। কাঠের বাক্স। একটা ডেকচেয়ার। সব যেন নীল আলোয় ডুবে আছে। ডেকচেয়ারে রোগ! লম্বা মানুষটা আজও শোওয়া। কোলে খোলা বাইবেল।
লোকটা খুব ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর ওপর দিকে চেয়ে গমগমে প্রতিধ্বনিত গলায় বলল, “তোমরা কিছু চাও? নেবে যিশুর এই চিহ্ন?”
গলা থেকে আশ্চর্য সুন্দর একটা সোনার ক্রস খুলে আনল লোকটা। ডান হাতে ক্রসটা উঁচু করে তুলে ধরল ওপর দিকে। এত দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিল, হিরে বসানো ক্রসটায় যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
“এসো, ধীরে ধীরে নেমে এসো। আলোর সিঁড়ি পাতা আছে। এসো।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো একে-একে লোকগুলো নেমে যেতে লাগল।
হরি জানে, সিঁড়ি নেই। সিঁড়ি ছিল না। তবু লোকগুলো যেন ঠিক সিঁড়ি বেয়েই নেমে যেতে লাগল। কারও মুখে কথা নেই। মূক, বাক্যহারা, পলকহীন।
নীচের নীল ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত নীল আলোর সমুদ্র যেন। লোকগুলো নামছে, নামতে নামতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে নীলের মধ্যে। বুদ্বুদের মতো।
পাগলা-সাহেব একা ক্রসটা তুলে ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কিন্তু কেউই শেষ অবধি তাঁর কাছে পৌঁছল না।
সাহেব ধীরে-ধীরে ক্রসটা আবার গলায় পরে নিলেন।
গমগমে কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “বিশ পা হেঁটে যাও পিছনে। রাস্তা পাবে। বিরক্ত কোরো না। আমি এখন বাইবেল পড়ছি।”
ভয়ে নয়, অদ্ভুত এক ভালবাসায় ভরে গেল হরির বুক। টপটপ করে চোখের জল পড়তে লাগল।
দরজাটা সাবধানে ভেজিয়ে দিয়ে হরি ফিরে আসতে লাগল। বিশ পা।
ঘটনার ছ’ মাস বাদের কথা। স্কুলের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল। হরিবন্ধু ফাস্ট।
খবরটা চাউর হতেই হেডস্যার ডেকে বললেন, “এইট-এ নয়, তোমাকে নাইন-এ তুলে দিচ্ছি, ডবল প্রোমোশন। যাও, মাস্টারমশাইদের প্রণাম করে এসো।”