অনেক সিঁড়ি ভেঙে নামতে হল তাকে। ডাইনে-বাঁয়ে অনেক পাক খেতে হল। মিনিট-দশেক বাদে একটা জায়গায় তাকে দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল হাত। তার কিছুক্ষণ পরেই একটা দরজায় তালা দেওয়ার শব্দ হল।
হাতকড়া দেওয়া হাত দুটো পায়ের তলা দিয়ে গলিয়ে সামনে এনে ফেলল হরি। মুখের ঢাকনাটা খুলে চারদিকে চাইল। অন্ধকারে যতটুকু বোঝা গেল, এটাও একটা নিচ্ছিদ্র গোল ঘর। গোলাকার ঘর এই সুড়ঙ্গে অনেকগুলো আছে বোধহয়।
হরি দরজাটা পরীক্ষা করে দেখল। খুবই মজবুত কাঠের দরজা। এ-দরজা ভেঙে হাতিও বেরোতে পারে কি না সন্দেহ। তা ছাড়া বেরিয়ে লাভই বা কী? ওপাশে ওরা বন্দুক-পিস্তল নিয়ে পাহারায় আছে।
হরি মেঝের ওপর চুপচাপ উবু হয়ে বসে রইল। আশপাশ দিয়ে ইঁদুর ৮০।
দৌড়চ্ছে। আরশোলা গায়ে বাইছে। মেঝে থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসছে নাকে। মাটির কত নীচে, কোন পাতালে তাকে আনা হয়েছে তা বুঝছে পারছিল না হরি। কত রাত হয়েছে তারও আন্দাজ নেই। ছাতুর তালটা কখন হজম হয়ে গেছে। এতক্ষণে ঝুমরি বোধহয় গরম ভাতের থালা এনে তাকে খুঁজছে।
হরি ক্লান্তিতে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে চোখ বুজল। কখন ঘুমিয়ে পড়ল, তা তার খেয়াল নেই।
ঘুম যখন ভাঙল, তখনও চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এই পাতালঘরে কোনও বাইরের আলো তো আসতে পারে না। ভোর হল কি না কে জানে! বড়ড খিদে পেয়েছে হরির। তার চেয়েও বেশি পেয়েছে তেষ্টা।
খুব ভয়ে-ভয়ে হরি অনুচ্চ স্বরে ডাকল, “কেউ আছেন? আমার বড় জলতেষ্টা পেয়েছে।”
তার গলার স্বর গভীর ঘরটায় গমগম করে প্রতিধ্বনিত হল। একটু বাদে দরজা ধীরে-ধীরে খুলে গেল। মোলায়েম কণ্ঠস্বর বলল, “জল নেই।”
একথায় যেন জলতেষ্টা আরও বেড়ে গেল হরির। সে বলল, “আমার তো কোনও দোষ নেই। আমাকে আটকে রেখেছেন কেন?”
“শুনেছি পাগলা-সাহেব তোমাকে পছন্দ করে খুব। তোমার বিপদ দেখলে সাহেব নাকি কবরে থাকতে পারে না, উঠে আসে ঘোড়ায় চেপে। আমরা তার জন্যই অপেক্ষা করছি। তোমাকে নয়, আমরা পাগলা-সাহেবকেই চাই।”
“এই কথা আপনাকে কে বলল যে, পাগলা-সাহেব আমাকে পছন্দ করেন?”
“কেন, তোমার চোর বন্ধু পটল দাস।”
“তাকে কোথায় পেলেন?”
মোলায়েম গলা একটু হাসল। বলল, “পেতে অসুবিধে হয়নি। সে তো তোমার ঘরে বসে চাতকের মতো ঊর্ধ্বমুখ হয়ে তোমার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। পিছন থেকে যখন আমার লোকেরা গিয়ে তাকে ধরে, তখন সে টু শব্দটিও করতে পারেনি।”
“পটলদা কোথায়?”
“আছে। তোমার পেয়ারের আরও লোকজনও এখন আমাদের কজায়। জগুরাম, তার বউ, দুটো বাচ্চা।”
হরি চমকে উঠে বলল, “তারা তো কিছু করেনি!”
“সেটা আমরা বুঝব।”
হরি হঠাৎ কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে একটা মেয়ের গোঙানি শুনতে পেল। সেইসঙ্গে দুটো কচি গলার ফোঁপানি। ওই কি ঝুমরি আর তার দুটো বাচ্চা? ভারী ঠাণ্ডা, ভাল মেয়ে ঝুমরি। তাকে কেন পাষণ্ডটা কষ্ট দিচ্ছে?
হরি কাতর গলায় বলল, “ওদের কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না?”
“দেব। পাগলা-সাহেবের দেখা পেলেই দেব। আর যদি আজ রাতে পাগলা-সাহেবের হদিস না পাই তা হলে তোমাদের ঠিক এই অবস্থায় ফেলে রেখে আমরা চলে যাব। অবশ্য প্রত্যেকের কপালের মাঝখানে একটা করে পিস্তলের গুলি চালিয়ে…”
হরি শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি দাঁড়াল। বলল, “শুনুন, নিজের চেষ্টায় পাগলা-সাহেবের কবর কেউ খুঁজে পায়নি। আমি পেয়েছিলাম আকস্মিকভাবে।”
লোকটা কথাটা বিশ্বাস করল না। একটু ঝাঁঝের গলায় বলল, “আমরা কতদূর মরিয়া তা বোধহয় তুমি এখনও বুঝতে পারছ না। ঠিক আছে, এসো আমার সঙ্গে।”
লোকটা অন্ধকারে তার হাত ধরল। এরকম শক্তিমান হাত হরি আর দ্যাখেনি। আঙুল যেন ডাইস মেশিন।
পাশেই একটা ঘরের দরজা খুলে টর্চের আলো ফেলল লোকটা।
হরি দেখল, নোংরা ধুলোর ওপর মেঝেয় হাত-পা বাঁধা ঝুমরি পড়ে আছে। মুখে কাপড় গোঁজা। তার দু’পাশে দুটো বাচ্চা শুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে মাঝে-মাঝে।
“এসো, পাশের ঘরে দেখবে এসো,” বলে লোকটা দরজায় তালা দিল।
পাশের ঘরে মেঝের ওপর পড়ে আছে জগুরাম। তার হাত-পা বাঁধা নেই বটে, কিন্তু বাঁধনের আর দরকারও নেই। জগুরামের শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। বাঁ হাতটা এমনভাবে মোচড়ানো যে মনে হচ্ছে ভাঙা। জগুরামের জ্ঞান নেই।
মোলায়েম গলা বলল, “খুব ভাল লোক নয় এ। খামোখা আমাদের সঙ্গে গা-জোয়ারি দেখাতে গেল।”
“ইশ। হয়তো বাঁচবে না।”
“বেঁচে থাকার দরকারটাই বা কী? এসো, তোমার বীর-পটলদার দশাও একটু দ্যাখো।”
লোকটা আর-একটা ঘর খুলে আলো ফেলল।
হরি অবাক হয়ে দেখল, পটল দাসের দুটো হাত দুটো দড়িতে বাঁধা, সেই দুই দড়িতে ঘরের মাঝবরাবর মেঝে থেকে অন্তত সাত ফুট ওপরে শূন্যে ঝুলছে। কপালে মস্ত ফোলা ক্ষতচিহ্ন, এখনও রক্ত গড়িয়ে মুখ ভেসে যাচ্ছে। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। খাস টানা এবং ফেলার ঘোরতর শব্দ হচ্ছে।
মোলায়েম কণ্ঠস্বর বলল, “কাল রাতে আমার দলের কয়েকজনকে আনাড়ি পেয়ে খুব ঘোল খাইয়েছিল। জানত না যে, ওস্তাদেরও ওস্তাদ আছে। একটু বেশি বীরত্ব দেখিয়ে ফেলেছিল বলেই এই শাস্তিটা ওকে দিতে হল।”
এতক্ষণ সহ্য করছিল হরি কোনওক্রমে। কিন্তু এই দৃশ্যটা দেখার পর তার মাথায় একটা রাগের আর দুঃখের পাগলা ঝড় উঠল। ঝুমরি, দুটো নিষ্পাপ বাচ্চা, সরল জগুরাম, পটলদা, এরা তো নিদোষ!