হরিবন্ধুর বুকটাও দুরদুর করছে। তবে কিনা পাগলা-সাহেব এ-পর্যন্ত তার উপকার ছাড়া অপকার তো কিছু করেনি! সে ধীরে-ধীরে সাহস সঞ্চয় করে সুড়ঙ্গে উঠে পড়ল।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে বাঁ দিকে ঠিক বিশ পা হাঁটল গুনে-গুনে। হঠাৎ এক ঝলক তীব্র টর্চের আলোয় ধাঁধিয়ে গেল তার চোখ। পরমুহূর্তেই লোহার মতো শক্ত দুটো হাত এসে দু’দিক থেকে তার দুটো হাত চেপে ধরল।
“কে? কে আপনারা?”
“চুপ, চেঁচিও না। চেঁচালে লাভও হবে না। চুপচাপ চলো, কবরটা আমাদের দেখিয়ে দাও।”
হরি লক্ষ করল, তাকে ঘিরে অন্তত আট-দশজন লোক। কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না ভাল করে, কারণ টর্চের আলোটা সোজা তার চোখে এসে পড়েছে। সে বলল, “কী চান আপনারা?”
“বলেছি তো, কবরটা।”
“কবর! আমি কবরের কথা কিছু জানি না।”
একটা বেশ নিরুত্তাপ মোলায়েম কণ্ঠস্বর বলল, “আমরা সবই জানি হরি। আমাদের সঙ্গে চালাকির চেষ্টা কোরো না। কবরটা দেখিয়ে দাও, তোমাকে আমরা ছেড়ে দেব। কিছু পুরস্কারও দেওয়া হবে।”
“না দেখালে?”
“দুঃখের সঙ্গে এই সুড়ঙ্গে আমরা আর-একটা কবর খুঁড়ব, সে কবর তোমার। আর তোমার ওই চোর বন্ধুটিকে আমরা টুকরো-টুকরো করে শেয়াল শকুনকে খাওয়াব। আমাদের সঙ্গে সে চুড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু তার ব্যবস্থা পরে হবে। এখন কবরটা আমাদের আগে দরকার।”
“এতগুলো লোকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনও আশাই নেই। হরি খুব দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। তারপর বলল, ঠিক আছে। আমার হাত ছেড়ে দিন, আর আপনারা আমার পিছনে আসুন।”
“হাত ছাড়া হবে না। আমাদের বোকা পাওনি।”
“হাত না ছাড়লে আমি রাস্তা গুলিয়ে ফেলব। খুব হিসেব কষে গুনে-গুনে পা ফেলতে হবে। হাত ধরা থাকলে সেটা সম্ভব নয়।”
আচমকাই দুটো হাত ছেড়ে দেওয়া হল হরির। মোলায়েম কণ্ঠস্বরটি বলল, “ছেড়ে দিলাম। কিন্তু মনে রেখো, তোমার দিকে তিনটে রিভলভার তাক করা আছে।”
হরি বিরক্তির সঙ্গে বলল, “বন্দুক-পিস্তল দিয়ে সব কাজ উদ্ধার হয়। টর্চটা নিবিয়ে ফেলুন, আমার অসুবিধে হচ্ছে।”
কী জানি কী ভেবে টর্চধারী হঠাৎ বাতিটা নিবিয়ে দিল। কিন্তু এমনভাবে আট-দশজন লোক হরিকে ঘিরে রইল যে, তাদের শ্বাস তার গায়ে লাগছিল, তাদের শরীরের উত্তাপও সে টের পাচ্ছিল।
যতদূর সম্ভব হিসেব কষে হরি যেখানে এসে দাঁড়াল, সেখানে নিরেট দেওয়াল। হরি একটু ভাবল। তার গোনায় কোনও ভুল হয়নি তো!
মোলায়েম কণ্ঠস্বর জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
“আবার সিঁড়ির গোড়া থেকে আসতে হবে। রাস্তাটা ভুল হয়েছে।”
“চালাকি ছাড়ো।”
হরি দৃঢ়স্বরে বলল, “আপনাদের জন্যই এমন হল। এবার আমাকে নিজের মনে কাজ করতে দিন। আপনারা তফাতে থাকুন।”
“বেশ ফন্দি।”
“ফন্দি মোটেই নয়। আপনারা ভালই জানেন, আজ পালাতে পারলেও কাল আমি ফের আপনাদের হাতে ধরা পড়ে যাব। আমি পালাব না। ভয় নেই, কিন্তু একটা কথা, কবরের মধ্যে পাগলা-সাহেব কিন্তু জেগেই বসে থাকেন।”
মৃদু একটু হাসির তরঙ্গ ছড়িয়ে গেল সকলের মধ্যে। মোলায়েম কণ্ঠস্বরটি বলল, “বেশ তো, একশো বছর আগেকার একটা মড়া যদি সত্যিই জেগে থাকতে পারে তবে তার একটা ইন্টারভিউ নেওয়া যাবে।”
আর একজন একটু স্তিমিত গলায় বলল, “পাগলা-সাহেব জেগে থাকবেন না। থাকলেও তাঁকে চিরদিনের মতো ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে।”
হরি একটু চমকে উঠল।
সিঁড়ির গোড়া থেকে হরি আবার পা গুনে-গুনে হাঁটতে লাগল। এবং কিছুক্ষণ পরে আবার গিয়ে ঠেকল নিরেট দেওয়ালে।
“এবার কী হল?”
“হরি মৃদু স্বরে বলল, “হচ্ছে না। গুলিয়ে ফেলছি।”
“নাকি চালাকি করছ?”
“তাতে লাভ কী? আবার দেখছি, ধৈর্য ধরুন।”
“ধরছি।”
হরি অন্তত দশবার চেষ্টা করল। একবারও কোনও রন্ধ্রপথ আবিষ্কার করতে পারল না। অথচ কাল রাতে…
চটাস করে তার গালে একটা চড় এসে এত জোরে ফেটে পড়ল যে, চোখে কিছুক্ষণ অন্ধকার দেখল হরি।
মোলায়েম গলা বলল, “হাঁটি-হাঁটি পা-এর খেলা এবার বন্ধ করো। আমরা সেই ছড়াটা জানি। ছুটেও না, হেঁটেও নয়, সাপের মতো। কাছেও নয়, দূরেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা। ঠিক কিনা?”
হরি জবাব দিল না। গালে হাত বোলাতে বোলাতে মনে-মনে ফুসতে লাগল।
মোলায়েম গলা বলল, “আমরা ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। আমরা কাজে বিশ্বাসী। এই ছড়াটা একটা সঙ্কেত। আমরা যেখানে যেতে চাইছি সেখানে পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। যেতে হবে সাপের মতো বুকে হেঁটে। আর জায়গাটা গভীরে, অর্থাৎ নিচু কোনও গর্ত বা পাতাল-ঘরে। সুতরাং
তোমার চালাকিটা খাটছে না।”
মাঝে-মাঝে টর্চের আলো জ্বলে উঠছে। সেই আলোর আভায় হরি লোকটাকে বুঝবার চেষ্টা করল। গলাটা যেমন নরম, চেহারাটা তত নয়। বেশ লম্বা-চওড়া শক্ত কাঠামোর চেহারা। দলের সবাই যে তাকে ভয় পায় তাতে সন্দেহ নেই। সে ছাড়া আর কেউ কোথাও কথা বলছে না।
মোলায়েম গলার স্বর শোনা গেল আবার, “কী, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে যে!”
“আমার কিছু মনে পড়ছে না।”
“ঠিক আছে, যখন মনে পড়বে তখন আমাদের ডেকো। ওরে, একে নিয়ে যা।”
সঙ্গে-সঙ্গে সাঁড়াশির মতো দুটো হাত এসে তার দুই বাহু ধরল। পিছন থেকে কে যেন তার মাথার ওপর দিয়ে একটা টুপির মতো জিনিস পরিয়ে সেটা টেনে নামিয়ে দিল গলা অবধি। মুখ-চোখ সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেল হরির। পিছমোড়া করে তার দু হাতে একটা হাতকড়া পরানো হল খট করে। তারপর তাকে টানতে টানতে কোথা থেকে যে কোথায় নিয়ে যেতে লাগল এরা তা বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে পারল না সে। সুড়ঙ্গটা যে ভয়ঙ্কর জটিল এবং পিঁপড়ের বাসার মতো অনেক ভাগে বিভক্ত, তা জানে হরি। এখানে হারিয়ে গেলে ফিরে আসা খুবই কঠিন।