গোপালদের বাড়ির পিছন দিকটায় খানিকটা পোড়ো জমি। চারদিকে কাঁটা ঝোঁপ। ঝোঁপের আড়ালে একটা টিনের ঘর। হরি খুব সাবধানে কাঁটা ঝোঁপের বেড়া টপকাল।
টিনের ঘরটায় তালা দেওয়া। কিন্তু ভিতরে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে। খুব সন্তর্পণে হরি দরজাটা ঠেলে একুখানি ফাঁক করল। চোখ রেখে দেখল, ভিতরে একটা সাদা ঘোড়া পা দাপিয়ে মশা তাড়াচ্ছে।
হরি একটু হাসল। কাল বিকেলে তাকে আর টুবলুকে রাজর্ষি আর তার দলের হাত থেকে যে বাঁচিয়েছিল, সে যে সাহেব নয় এবং পাগলাও নয়, তাতে সন্দেহ নেই। রং-মাখা সাদা মুখটা এক ঝলক দেখে মনে রেখেছিল হরি। আর ঝিকু-সদারের মুখে সেই মুখের আদল দেখেই তার মনে হয়েছিল, পাগলা-সাহেব আসলে..
হরি ভাবতে ভাবতে নিজের বাসায় ফিরে এল।
ঝুমরি ফের একটা ছাতুর তাল দিয়ে গেল। আনমনে হরি সেটা যখন খাচ্ছিল তখন দরজার কাছে খুব বিনীতভাবে কে যেন কাসল একটু।
হরি চেয়ে দেখল, পটল দাস। চোখে মিটমিটে দৃষ্টি, মুখে অপরাধী হাসি।
হরি মুখটা গম্ভীর রেখে বলল, “কী খবর?”
পটল ঘরে ঢুকে উবু হয়ে হঠাৎ হরির দু’খানা পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বলল, “ব্রাহ্মণ মানুষ তুমি, বয়সে ছোট তো কী! আমায় মাফ করে দাও।”
হরি তাড়াতাড়ি পা টেনে নিয়ে বলল, “ওটা কী হচ্ছে!”
পটল দাস তার চাঁদরের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বলল, “আমার মাথায় কাল শয়তানে ভর করেছিল। তোমার গলা টিপে ধরেছিলুম। কিন্তু যে-কোনও দিব্যি করে বলতে পারি, তোমাকে মারতুম না। ইচ্ছে ছিল, অজ্ঞান করে ফেলে কাঁধে করে নিয়ে তোমাকে গুম করে রাখব।”
“কেন বলো তো!”
পটল দাস ভেউ-ভেউ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর বলল, “বহুকাল আগে এক পাগলা-ফকির একটা অদ্ভুত কথা হাটে মাঠে বলে বেড়াত। ছুটেও নয়, হেঁটেও নয়, সাপের মতো…”
হরি বাকিটা পূরণ করে দিল, “কাছেও নয়, দূরেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা।”
পটল চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি জানো?”
“জানি। হেডমাস্টারমশাই ছড়াটার কথা আমাকে বলেছিলেন।”
পটল দাস কিছুক্ষণ মুখ ঢেকে বসে থেকে ধরা গলায় বলল, “তোমার কাছে কিছু লুকোব না। পাগলা-সাহেবের ভূত ঘুরে বেড়ায় বলে লোকে বিশ্বাস করে। কিন্তু আসলে আজ অবধি আমি নিজে কখনও দেখিনি। কিন্তু…”
হরি ছাতুর শেষ দলাটা গিলে ফেলে বলল, “কিন্তু তোমরা কয়েকজন পাজি লোক পাগলা-সাহেব সেজে মাঝে-মাঝে দেখা দাও। লোকের মনে বিশ্বাস জন্মানোর জন্য।”
পটল দাস হরির মুখের দিকে চেয়ে অবাক গলায় বলল, “ তা হলে তুমি ধরতে পেরেছ? বাস্তবিকই তোমার খুব বৃদ্ধি। আমি তোমাকে প্রথমটায় বোকা ঠাউরেছিলুম।”
“কিন্তু তোমরা এটা কেন করো পটলদা?”
“মোতিগঞ্জের লোকেদের ভালর জন্যই। অন্যায় করলে, পাপ করলে পাগলা-সাহেব এসে হাজির হবেন। লোকে তাই খারাপ কাজ করার আগে একটু ভাববে। বিশ্বাস করো, আমাদের খারাপ মতলব কিছু ছিল না।”
“পাগলা-সাহেব কে সাজত?”
“কখনও ঝিকু, কখনও তার ছেলে গোপাল, আমিও সেজেছি। এক রকম মজাও ছিল খেলাটায়। কিন্তু কাল রাতে..,” বলে থেমে গেল পটল দাস। হাতখানা হরির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই দ্যাখো, রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।”
“কাল রাতে কী?”
“কাল রাতে যখন তোমার গলা টিপে ধরেছিলুম তখন যে-লোকটা সাদা ঘোড়ায় চেপে ছুটে এল, সে কিন্তু আমাদের কেউ নয়।”
একটু কাঁপা গলায় হরি বলল, “সে তা হলে কে পটলদা?”
পটল দাস জুলজুল করে হরির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “সেই কথাটাই জানতে এসেছিলুম তোমার কাছে। সে লোকটা কে? বুড়ো বয়স, চোখে ছানিও পড়েছে, কিন্তু তবু অন্ধকারে যেটুকু ঠাহর করতে পেরেছিলুম তা মনে করলে শরীর হিম হয়ে আসে।”
“তুমি কী দেখেছিলে?”
“একটা সাদা ঘোড়া ধেয়ে এল। তার ওপর সওয়ার এক লম্বাপানা রোগা সাহেব। চোখ দুটো জ্বলছিল ধকধক করে। সে আমাদের দিকে ছুটে এল, আমাদের ওপর দিয়েই ছুটে গেল, কিন্তু শুধু একটা ঝোড়ো বাতাস ছাড়া কিছুই টের পেলুম না। ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুট লাগালুম। হুমড়ি খেয়ে পড়লুম গিয়ে ওই ভাঙা পাঁচিলটার গায়ে। বহুকাল এরকম ভয় পাইনি।
“তারপর কী করলে?”
“কী করলুম, তা আর ঠিক মনে নেই। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলুম কিছুক্ষণ। এখনও আমার ধন্দ ভাবটা যায়নি। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি, সত্যিকারের পাগলা-সাহেবও ঘোড়ায় চেপে বেরোন বটে। আর তোমার ওপর তাঁর নজরও আছে। একটা কথা সত্যি করে বলবে? কাল সুড়ঙ্গের মধ্যে যা দেখেছিলে তা বানিয়ে বলোনি তো?”
“না পটলা, বানিয়ে বলার মতো বুদ্ধি আমার নেই।”
“ওরে বাবা! যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তোমার বড় বিপদ।”
“কেন, বিপদ কিসের?”
“পাঁচজনে জেনেও গেছে কিনা যে, তুমি কবরের হদিস পেয়েছ।”
“কে রটাল কথাটা?”
“ও কথা কি চাপা থাকে? যাকগে, এখন কথাটা হল, সেই কবরের হদিসটা তো দরকার।”
হরি হেসে বলল, “হদিস কিছু শক্তও নয়। চলো, দেখিয়ে দিচ্ছি।”
পটল সভয়ে চেয়ে বলল, “আমি! ও বাবা, আমি পাপী-তাপী মানুষ, পাগলা-সাহেব আমাকে ভস্ম করে ফেলবে। বরং আমি এখানে বসে থাকি। তুমি যাও গিয়ে জায়গাটা একবার দেখে একটু চিহ্ন রেখে এসো।”
হরি রাজি হল। পটল তাড়াতাড়ি টেবিলের ওপর চেয়ার তুলে ফেলল। মুখ-ঝাড়ুনি দিয়ে ছবিটাও সরিয়ে দিল। চাপা গলায় বলল, “জয় মা কালী।”