এ-কথায় হরি লজ্জায় হেঁটমুণ্ডু হল।
হেডস্যার মৃদু গম্ভীর গলায় বললেন, “ঠিক আছে। এখন যাও। মন দিয়ে পড়াশুনো করবে, নিজের দিকে লক্ষ রাখবে। কোনও সাহায্যের দরকার হলে মাস্টারমশাইদের কাছে বলবে। তোমার আচরণে আমি খুশি হয়েছি।”
হরি আনন্দে ভাসতে ভাসতে ক্লাসে এসে বসল। গোপাল আজও ক্লাসে ছিল না। হরি চোরা চোখে লক্ষ করল, গদাধর, রাজর্ষি, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স কেউই আজ ক্লাসে নেই। না থাকরই কথা। তাদের ক্লাসে দেখলে খুবই অবাক হত হরি। তবে টুবলু এসেছে। পিছনের বেঞ্চ থেকে তাকে একবার হাত তুলে ইশারা করল।
আজ মাস্টারমশাইরাও কে জানে কেন খুবই ভাল ব্যবহার করছিলেন হরির সঙ্গে। ভূগোলস্যার ব্যোমকেশবাবু দুর্দান্ত রাগী মানুষ। তাঁর ক্লাসে হরি হোয়াংহো নদী কোথায় তা বলতে না পারায় ব্যোমকেশবাবু কিন্তু একটুও রাগ করলেন না। শুধু বললেন, “চিনের দুঃখ যেন তোমারও দুঃখের কারণ না হয়, দেখো।”
টিফিনে টুলু আর হরি একসঙ্গে বেরোল বাদাম খেতে। হরি জিজ্ঞেস করল, “গোপাল কেমন আছে টুলু?”
টুবলু মাথা নেড়ে বলল, “ভাল নেই। প্রচণ্ড জ্বর এসেছে আর ভুল বকছে। বারবার তোমার নামও বলছে।”
“আমার নাম করে কী বলছে?”
“ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে-মাঝে বলছে, ‘হরি, ছেড়ো না, তুমিই পারবে।”
“তার মানে কী?”
“প্রলাপের কি মানে থাকে?”
“আর-একটা কথার জবাব দেবে টুলু? এখানকার সবাই পাগলা-সাহেবের কবর নিয়ে এত ভাবে কেন?”
“আমি অত জানি না। তবে যতদূর শুনেছি পাগলা-সাহেবের কবরটা সাধারণ কবর নয়। মাটির তলায় একটা ঘরে তার কফিন রাখা আছে। যদি কেউ সেই ঘরের বাতাস থেকে একটু শ্বাস টেনে নিয়ে আসতে পারে তা হলে তাকে আর পায় কে!”
“কী হবে তার?”
“সে রাজা হয়ে যাবে। মোতিগঞ্জের সকলেই তাই কবরটা খোঁজে। আর কিছু লোক আছে, যারা এ-গল্প বিশ্বাস করে না, কিন্তু তারাও কবরটা খোঁজে ওই ক্রসটার জন্য।”
“তুমি কি সত্যিই পাগলা-সাহেবের গল্প বিশ্বাস করো?”
“করি। কাল তুমিও তো দেখলে।”
হরি মাথা নেড়ে বলল, “এ-পর্যন্ত দু’-দু’বার পাগলা-সাহেব আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমি তাঁকে অবিশ্বাস করি না, কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“থাক সে কথা, পরে হবে। আমি আজ ছুটির পর গোপালকে দেখতে যাব, আমাকে নিয়ে যাবে?”
“নিশ্চয়ই।”
৯. গোপালদের পাড়াটা শহরের এক প্রান্তে
গোপালদের পাড়াটা শহরের এক প্রান্তে। একটু ঘিঞ্জি, নোংরা, গরিব পাড়া। গোপালদের বাড়িটাও বেশ পুরনো, একটু ভাঙাটাঙাও বটে। ভিতরের দিকে একখানা ঘরে গোপাল ঘোর জ্বরের মধ্যে শুয়ে ছিল। তার মা মাথায় জলপটি দিচ্ছে, পিসি আর ঠাকুমা বসে আছেন পাশে। বিভীষণ-চেহারার ঝিকু-সদার পায়চারি করছে ঘরে।
হরি ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, “গোপাল কেমন আছে?”
ঝিকু-সদার তার দিকে চেয়ে থমকে গেল, বলল, “ভাল নেই, মেলা ভুল বকছে। তোমার নামই কি হরি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“এসো, পাশের ঘরে এসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।” পাশের ঘরে হরিকে একটা মোড়ায় বসিয়ে মুখোমুখি আর-একটা মোড়ায় বসে ঝিকু বলল, “কাল রাতে সুড়ঙ্গের মধ্যে তুমি কী দেখেছ? কোনও মানুষকে?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে সে-কথা কে বলল?”
“পটল দাস। তার এখন মাথার ঠিক নেই।”
“হ্যাঁ, পটলদা কাল রাতে আমাকে আর-একটু হলেই মেরে ফেলেছিল।”
ঝিকু-সদার মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু বিশ্বাস করতে পারো, পটল খুনটুন কখনও করেনি, তার ধাতই সেরকম নয়। তবে কাল তোমার কথা শুনে তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল।”
হরি একটু অবাক হয়ে বলল, “এতে মাথা বিগড়োবার কী আছে, আমি বুঝতে পারছি না। সুড়ঙ্গের অনেকগুলো মুখ। সেগুলো একটা করে ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। তেমনি একটা ঘরে আমি লোকটাকে দেখি।”
ঝিকুর চোখ ঝলসে উঠল। চাপা গলায় সে বলল, “লোকটা দেখতে মেন ছিল?”
“রোগা, ফর্সা, নীল চোখ।”
“সেই ঘরে কী ছিল?”
“একটা কাঠের বাক্স, একটা ডেকচেয়ার। আর তেমন কিছু নয়।” ঝিকু উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে মাথা নেড়ে বলল, “নাঃ, অসম্ভব! এ হতেই পারে না! তুমি মিথ্যে কথা বলছ।”
হরি অবাক হয়ে বলল, “এতে মিথ্যে কথা বলার কী আছে?”
“ওই সুড়ঙ্গের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা আমি আর পটল তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কখনও ওরকম কিছু দেখিনি। তুমি ভুল দ্যাখোনি তো!”
হরি এবার একটু হেসে বিনীতভাবে বলল, “ভুল দেখাও সম্ভব। কিন্তু তার আগে বলুন, আপনারা কথাটা শুনে এরকম অবিশ্বাস করছেন কেন?”
ঝিকু অবাক হয়ে বলল, “তুমি কী দেখেছ তা কি এখনও বুঝতে পারছ? গোলঘরে নীল আলো, রোগা-ফসা একজন লোক বসে বাইবেল পড়ছে। সত্যিই বুঝতে পারছ না?”
“না। তবে এখন মনে হচ্ছে…।”
“হ্যাঁ। ঠিকই মনে হচ্ছে। সারা মোতিগঞ্জের লোক বহুকাল ধরে বহু ঘাম ঝরিয়ে, বহু মাথা খাঁটিয়ে যা বের করতে পারেনি, তুমি সেই পাগলা-সাহেবের কবর দেখেছ!”
এতক্ষণে হরির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। শরীরে একটা হিম স্রোত নেমে গেল।
হরি আর বসল না। পরে আসবে বলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। বাইরে টুবলু তার জন্য অপেক্ষা করছিল। হরি তাকে বলল, “তোমাকে আর আমার সঙ্গে যেতে হবে না। তুমি বাড়ি যাও।”
টুবলু একটু হেসে মাথা নেড়ে চলে গেল।
.
হরি গোপালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকদূর হনহন করে হেঁটে গেল। তারপর রাস্তা জনহীন হয়ে গেলে সে চারদিকে চেয়ে টপ করে রাস্তা থেকে নেমে মাঠ আর জঙ্গলের ঘুরপথে ফিরে আসতে লাগল গোপালের বাড়ির দিকে। সন্ধে হয়ে এসেছে। গা-ঢাকা দেওয়ার সুবিধে খুব। ঝিকু-সদারের সঙ্গে কথা বলার সময় সে একটা ঘোড়ার ডাক শুনেছে।