কে করল? কখন করল?
.
শরীরটা বড়ই ক্লান্ত লাগছিল হরির। সে খানিকটা জল খেয়ে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
সকালে ঘুম ভাঙল ঝুমরির ডাকে। তার জলখাবার নিয়ে এসেছে।
ঝুমরি কথা প্রায় বলেই না। কিন্তু আজ হরি দরজা খুলবার পর ঝুমরি খুব অবাক হয়ে হরির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঘরে ঢুকে থালাটা টেবিলে রেখে তার দিকে ফিরে বলল, “কে তোমার গায়ে হাত দিয়েছে? তার নাম বলো। জগুরাম গিয়ে তার মুণ্ডু ছিঁড়ে আনবে।”
হরি শশব্যস্ত হয়ে বলল, “কেউ মারেনি, আমি পড়ে গিয়েছিলাম।”
“ঝুট বাত। সাচ বোলো, ম্যায় খুদ উস গুণ্ডেকো সিধা বনায়েঙ্গ।” এই বলে ঝুমরি তার আঁচল কোমরে জড়াল। তার চোখমুখ একেবারে ধকধক করছে।
ঝুমরি যে তার জন্য এতটা উতলা হবে, তা হরি স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তবে সে মাথা নেড়ে দৃঢ় গলায় বলল, “আমাকে কেউ মারেনি, বিশ্বাস করো। আমি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, তখন একটু চোট লেগেছে মুখে।”
ঝুমরি বিশ্বাস করল কি না কে জানে, তবে চলে গেল। একটু বাদেই জগুরাম এসে ঘরের মাঝখানটায় তার বিশাল চেহারা নিয়ে খাড়া হল। বলল, “ঝুমরি আমাকে খুব বকছে, আমি তোমার দেখভাল ঠিকমতো করছি না বলে। তা কে তোমার দুশমন বলো, তাকে লাঠিপেটা করে দিয়ে আসি।”
হরি জগুরামের ভাবভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল, “তোমাকে ভাবতে হবে না জগুরাম। এখানে আমার কয়েকজন ভাল বন্ধু আছে। কিন্তু একটা কথা। কিছু বদমাশ লোক কুসুমকুঞ্জ আর গ্রিন ভ্যালিতে আনাগোনা করছে। তুমি একটু নজর রেখো।”
“ঠিক আছে।” বলে জগুরাম চলে গেল।
হরি খেয়েদেয়ে স্কুলে গেল আজও। তিনদিন ধরে স্কুলে, রাস্তায়, বাড়িতে বারবার মারধর খেয়ে এবং কাল রাতে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েও সে দমে যায়নি। রহস্য ভেদ করার তীব্র একটা কৌতূহলই তাকে চাঙ্গা রেখেছে।
ফাস্ট পিরিয়ডের পরই বেয়ারা একটা চিরকুট নিয়ে ক্লাসে এল। হেডমাস্টারমশাই হরিবন্ধুকে তাঁর ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন।
দুরুদুরু বুকে হরিবন্ধু বেয়ারার পিছন-পিছন বেরিয়ে এল ক্লাস থেকে।
হেডস্যার যেমন গম্ভীর, তেমনি ব্যক্তিত্ববান রাশভারী মানুষ। আজ তাঁকে একটু বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
হরি তাঁর অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকবার পর তিনি হরির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হরিকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে পেল।
কিছুক্ষণ চেয়ে থাকবার পর তিনি খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?”
হরি মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার।”
হেডস্যার কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে খুব ধীরে-ধীরে বললেন, “আমার কর্তব্য প্রত্যেকটি ছাত্রের দিকে নজর রাখা, প্রত্যেকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, প্রত্যেকের উন্নতিসাধনে সাহায্য করা। সবসময়ে আমি তা পেরে উঠি না। তুমি হয়তো জানো, এটা ভাল ছেলেদের স্কুল নয়। রিফর্মেটরি স্কুল হিসেবেই এটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু যতটা করা উচিত, ততটা আমরা পেরে উঠি না। অনেক আজেবাজে ছেলে ছাত্র সেজে এখানে ঢোকে। তারাই নানারকম খারাপ কাজও করে। আমি খবর পেয়েছি, এই স্কুলের কয়েকটা ছেলে তোমার ওপর চড়াও হয়েছিল। তুমি কি তাদের নাম বলতে পারবে?”
হরি মাথা নিচু করে রইল। সহপাঠীরা যত খারাপই হোক, তাদের নাম বলে দেওয়াটা হরি একরকম বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে।
হেডস্যার মৃদুস্বরে বললেন, “বলতে ভয় পাচ্ছ?”
“ঠিক তা নয় স্যার।”
“বুঝেছি। ইটস এ গুড জেশ্চার। কিন্তু যাদের বাঁচাতে তুমি মহত্ত্ব দেখাচ্ছ তারা বোধহয় তত ভাল নয়। আর-একটা কথা…।”
“বলুন স্যার।”
“এখানে পাগলা-সাহেবের নামে একটা কিংবদন্তি চালু আছে। তুমি কি তা শুনেছ?”
“হ্যাঁ।”
“আমি যদিও ওরকম কিংবদন্তিতে খুব আস্থাবান নই, তবে কোনও সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়াটাও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক নয়। আমি এখানে অনেকদিন আছি, কিন্তু কখনও পাগলা-সাহেবকে দেখিনি। তবে অনেকে দেখেছে বলে শোনা যায়। শুনেছি, তার কবর খুঁজতে মোতিগঞ্জে কিছু পাজি লোক হানা দিয়েছে। সত্যি-মিথ্যে জানি না,…”
হেডস্যারকে কথা শেষ করতে না দিয়েই উত্তেজিত হরি বলে উঠল, “সত্যি স্যার।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ স্যার। আর পাগলা-সাহেবের কিংবদন্তিও সত্যি। আমি নিজে চোখে দেখেছি।”
হেডস্যার অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “খুবই আশ্চর্যের কথা। এবার তোমাকে একটা ছড়া বলি, দ্যাখো তো, কখনও শুনেছ কি না। হেঁটেও নয়, ছুটেও নয়, সাপের মতো। দূরেও নয়, কাছেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা।”
হরি মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার, এ-ছড়া কখনও শুনিনি।”
“ছড়াটা খুবই অদ্ভুত এবং মোতিগঞ্জের অনেকেই জানে। ছড়াটা নাকি সাঙ্কেতিক। তবে এই সঙ্কেতের অর্থ আমি কখনও ভেদ করতে পারিনি।
তুমি পাগলা-সাহেবকে দেখেছ শুনেই ছড়াটা তোমাকে বললাম।”
“এ-ছড়ার সঙ্গে কি পাগলা-সাহেবের সম্পর্ক আছে স্যার?” “তাই তো শুনি।”
হরি বিড়বিড় করে ছড়াটা নির্ভুল আওড়াল, “হেঁটেও নয়, ছুটেও নয়, সাপের মতো। দূরেও নয়, কাছেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা।”
“বাঃ, একবার শুনেই তোমার মুখস্থ হয়ে গেছে দেখছি! দুখিরামবাবু চিঠিতে জানিয়েছিলেন, তুমি খুব ডাল-হেডেড ছেলে বলে তোমার বাবার ধারণা, কিন্তু তা তো নয়। স্মৃতি এবং গ্রহণক্ষমতা খুব অদ্ভুত জিনিস। মন যেটা চায় সেটা সহজেই শেখা যায়। পড়ার জন্য পড়লে সহজে শেখা যায় না, আবার জানার আগ্রহ নিয়ে পড়লে, টপ করে শেখা হয়ে যায়। তোমার ব্রেন মোটেই খারাপ নয়। শুধু দরকার একটু আগ্রহ।”