“তা হলে?”
“সেইটেই তো হয়েছে মুশকিল। বুড়ো বয়সে কী যে ভালবাসি আর কী যে ভালবাসি না, সেইটেই ঠাহর পাই না। এই যে এই লম্বা হয়ে পড়ে আরামে জিরেন নিচ্ছে লোকটা, একে নিয়েই বা কী করা যায় কিছু মাথায় খেলছে না। বুড়ো হলে মাথাটারও বয়স বাড়ে কিনা। আপাতত একে চব্বিশ ঘণ্টার মতো ঘুম পাড়িয়ে রাখি। তারপর দেখা যাবে।”
বলে পটল দাস ট্যাঁক থেকে একটা ছোট শিশি বের করল। শিশিটা খুলে লোকটার নাকের কাছে ধরল একটু। ফের ছিপি বন্ধ করে ট্যাঁকে রেখে বলল, “এবার চলল, ওই ঝোঁপটার মধ্যে ঠেসে দিই লোকটাকে।”
হরি চোখ গোল করে কাণ্ডটা দেখছিল। বলল, “ওটা কী শোঁকালে?”
“এও এক টোটকা রে বাপ। চব্বিশ ঘণ্টা টানা ঘুমাবে এখন বাছাধন। গায়ের ওপর দিয়ে মোষে হেঁটে গেলেও টের পাবে না। একটু বেশি শুকিয়ে দিলেই অক্কা। এক নাগা সাধু দিয়েছিল। কিন্তু আর দেরি করা ঠিক হবে না। এদের আসল সর্দার এসে পড়তে দেরি নেই। সে এদের মতো আনাড়ি নয়।”
দু’জনে মিলে লোকটাকে ধরাধরি করে একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর হরি জিজ্ঞেস করল, “আসল সর্দারটি আবার কে?”
“তা আমি কী জানি।”
“এই যে বললে, সে আনাড়ি নয়। তার মানে তাকে তুমি চেনো।”
“ফুলকপির পোড়ের ভাজা দিয়ে খিচুড়ি তোমার কেমন লাগে? সঙ্গে যদি বেশ মচমচে আলুর চপও থাকে?”
“ভালই। কিন্তু আমার ঘরের সুড়ঙ্গের গর্তটা খোলা রয়েছে সে খেয়াল আছে? আর এই যে লোকটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখলে, এর স্যাঙাতটা কি একে খুঁজতে আমার ঘরে গিয়ে হানা দেবে না? সুড়ঙ্গটা তো হাঁহাঁ করছে।”
পটল দাস নির্বিকার মুখে বলল, “ও কি আর লুকনো যাবে রে ভাই? যে সুড়ঙ্গের এতগুলো মুখ চারদিকে ছড়ানো রয়েছে তা কি আর বেশিক্ষণ লুকনো যায়? আর এরাও তো ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। খুঁজে বের করতই।”
“তা হলে কী হবে?”
“কী আর হবে? সুড়ঙ্গে আমি নিত্যিদিন ঘুরে বেড়াই। কিছুই নেই। ওরা যদি সুড়ঙ্গে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতে চায় তো মরুকগে। তাতে বরং আমাদের খানিকটা সময় বাঁচবে। খিচুড়িটাকে আর ঠাণ্ডা হতে দেওয়া ঠিক হবে না।”
হরি একটু চিন্তিতভাবে বলল, “সে অবশ্য ঠিক কথা। গোলঘরের সেই লোকটাও দেখলাম সুড়ঙ্গটা বেশ চেনে। আমি জিজ্ঞেস করতেই পথ দেখিয়ে দিল।”
পটল দাস একটা হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করল হঠাৎ। তারপর চাপা গর্জনের মতো স্বরে বলল, “কী বললে? গোলঘর!”
হরি মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। কুয়োর মতো গোল আর অনেকটা গভীর। নীল আলো জ্বলছিল ঘরে। একটা কাঠের বাক্স…”
কথা শেষ করার আগেই তার মুখে একটা থাবড়া এসে পড়ল। পটল দাস হিংস্র একটা গর্জন ছেড়ে বলল, “চোপ!”
হরি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পটলের এই আকস্মিক আচরণে। থাবড়ায় তার ঠোঁট কেটে রক্তের নোনা স্বাদ ঠেকছিল জিভে। সে অবাক হয়ে বলল, “ওরকম করছ কেন?”
পটল দাসের চেহারাটা অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছিল হরি। চোখ দুটোয় জ্বলজ্বলে আগুন। খুনির গলায় সে বলল, “মিথ্যে কথা। তুমি বানিয়ে বলছ। গত ত্রিশ বছর আমি সুড়ঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। আনাচকানাচ কিছু বাকি নেই। আমি কখনও ওরকম ঘর দেখতে পাইনি। তুমি পেলে কী ভাবে?”
হরির গা কেমন যেন শিউরে উঠল ভয়ে। শরীরটা হিম। সে আমতা-আমতা করে বলল, “হঠাৎ আমার পা পিছলে গিয়েছিল। পড়ে গড়িয়ে গেলাম অনেকটা ঢালুতে। একটা কাঠের চৌকো দরজায়…”
পটল দাস আচমকাই আবার একটা থাবড়া মারল তার মুখে। তারপর তেমনই হিংস্র গলায় বলল, “তা হলে তোমাকে এখনই নিকেশ করা দরকার। এখনই। নইলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে…”
বলতে বলতে দুটো হাত সাঁড়াশির মতো হরির গলা চেপে ধরল।
হরি এত অবাক হয়ে গেল যে, বাধাটুকু পর্যন্ত দিতে পারল না। দমবন্ধ হয়ে চোখ কপালে উঠল তার। কপালে চিনচিন করে ঘাম ফুটে উঠতে লাগল। জিভ বেরিয়ে এল।
মরেই যাচ্ছিল হরি। মনে-মনে সে বুঝতে পারছিল, বাঁচবার আর কোনও আশাই তার নেই। কিন্তু পটল দাস তো মজার লোক। চোর হলেও মানুষটা ভাল। তার সঙ্গে এত ভাব। তবু তাকে পটল দাসের হাতেই মরতে হচ্ছে?
আচমকাই মাটির গভীর থেকে এক গুড়গুড় ধ্বনি উঠে এল। দ্রুত ধাবমান এক ধ্বনি।
নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারকে চমকে দিয়ে এক তেজীয়ান ঘোড়া তীব্র হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। তারপরই ঝড়ের গতিতে সাদা একটা ঘোড়া অন্ধকারে বিদ্যুচ্চমকের মতো ছুটে এল তাদের দিকে।
কী যে হল কিছুই বুঝতে পারল না হরি। তার হঠাৎ গলার চাপটা সরে যেতেই সে উবু হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। তারপর কাসতে লাগল। কিছুক্ষণ সে বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো বসে বসেই শুনতে পেল ঘোড়ার পায়ের শব্দ দূর থেকে দূরান্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপর ধীরে-ধীরে ধাতস্থ হয়ে সে চারদিকে চেয়ে দেখল। না, ঘোড়া অদৃশ্য হয়েছে। তারপর পটল দাসও কোথাও নেই। স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে।
কে তাকে বাঁচাল? আবার পাগলা-সাহেব?
হরি উঠে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এসে ভাঙা পাঁচিল টপকে বাগান পার হয়ে নিজের ঘরে এসে ক্লান্তভাবে বসে পড়ল বিছানায়। মাথার ভিতর বড়ই ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল।
খানিকটা জিরিয়ে সে উঠল। দেওয়ালের গর্তটা বন্ধ করতে হবে। চেয়ার-টেবিল জায়গাতে রাখতে হবে।
ঝুলঝাড়ুনিটাকে নিয়ে ছবিটা সরাতে গিয়ে সে অবাক হয়ে দেখল, ছবিটা নিখুঁতভাবে গর্তটা ঢেকে টাঙানো রয়েছে। তার চেয়ার-টেবিল জায়গামতো সাজিয়ে রাখা। এতক্ষণ উত্তেজনার বশে সে খেয়াল করেনি।